পেশাকে নিঃশেষ হতে দেয়া যাবে না
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক (অনার্স) ও স্নাতকোত্তরের (মাস্টার্স) পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে ফারসি ভাষায় সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর ফোর্ড ফাউন্ডেশন বৃত্তি নিয়ে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখন অধ্যাপনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। পাঠ্যক্রমভিত্তিক গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ও বিলুপ্তপ্রায় পেশা নিয়ে ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক হোসাইন।
জাগো নিউজ : কালের বিবর্তনে অনেক পেশা আজ হারিয়ে গেছে। অনেক পেশা বিলুপ্তির পথে। এসব পেশার মধ্যে অনেক ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যের ধারক সেইসব পেশার মধ্যে কোনগুলো উল্লেখযোগ্য?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : দেশে বিভিন্ন যুগপটে নানারকম পেশাজীবী আমরা পেয়েছি। সময়ের সঙ্গে অনেক পেশা হারিয়ে গেছে। রাজধানীকেন্দ্রিক কিছু উল্লেখযোগ্য পেশা ছিল। এর মধ্যে কিছু পেশা ঊনিশ শতক পর্যন্ত চলেছে। বিশ শতকে আধুনিকতার জোয়ারে স্বাভাবিকভাবেই সে সব পেশা প্রায় হারিয়ে গেছে।
একসময় ঢাকায় পানির জন্য প্রায় বাড়িতেই কুয়ো ছিল। পানি তুলতে গিয়ে বধূদের কানের দুলের মতো বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস কুয়োতে পড়ে যেত। এসময় এক ধরনের পেশাজীবী দু’আনা-চার আনার বিনিময়ে কুয়ো থেকে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান জিনিস খুঁজে বের করতেন। তারা কুয়ো পরিষ্কারের কাজও করতেন। এই পেশাজীবীদের ‘কুয়োওয়ালা’ বলা হতো। কালের বিবর্তনে এখন আর কুয়োর ব্যবহার নেই। তাই কুয়োওয়ালার অস্তিত্বও হারিয়ে গেছে।
ওই সময় ঢাকায় আরেকটি শ্রেণি পানি বিক্রি করত। বুড়িগঙ্গার পানি তুলে এনে তা বিক্রি করা হতো। তখন বুড়িগঙ্গার পানি স্বচ্ছ ছিল। যারা এ পানি বিক্রি করতেন তাদের ‘ভিস্তিওয়ালা’ বলা হতো। পানির সেই পাত্রকে ‘মশক’ বলা হতো। এটি ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি ছিল। পানি বিক্রেতাদের ‘মশকওয়ালা’ নামেও ডাকা হতো। এক আনা দুই আনার বিনিময়ে তারা পানি সরবরাহ করতেন। তাদেরও এখন আর পাওয়া যায় না।
জাগো নিউজ : ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত আর কী কী ধরনের পেশা বিলুপ্ত হয়েছে?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : বিড়ি-সিগারেট আসার আগে মানুষ হুঁকা গ্রহণ করতেন। হুঁকাকে ঘিরে একাধিক পেশা তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত হুঁকায় একটি কাঠের নল থাকত। নলটি লাগানো থাকত একটি অভঙ্গ নারকেলের মালায়। এর একপাশে ছোট ছিদ্র থাকত। নলের উপরের অংশে মাটির কলকি থাকত। কলকির ওপর টিকা বা টিক্কা থাকত।
হুঁকাকে ঘিরে কাঠমিস্ত্রি, নারকেলের মালা প্রক্রিয়াজাতের জন্য আরেক শ্রেণির পেশাজীবী এবং মাটির কলকি বানানোর জন্য কুমারদের প্রয়োজন ছিল। এছাড়া ঢেঁকিতে কাঠ কয়লা গুঁড়া করে তা দিয়ে টিকা বানাতে হতো। এই কাজটি মেয়েরা করত। শুধু হুঁকার সঙ্গেই এত ধরনের পেশাজীবী টিকে ছিল।
অনুমান করা হয়, হুঁকার জন্য টিকা তৈরির কারিগররা আজকের ঢাকার টিকাটুলী নামক স্থানে বসবাস করতেন। এ কারণেই সেই স্থানকে ‘টিকাটুলি’ নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
জাগো নিউজ : আধুনিকতার ছোঁয়ায়ই বিলুপ্ত হচ্ছে এসব পেশা?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : বাংলাদেশে এক সময় সাবান বানানো হতো। হাতে তৈরি এই সাবানকে ‘বাংলা সাবান’ বলা হতো। ছোট ছোট ফুটবলের মতো আকৃতির এই সাবানের কোনোটার ওজন ছিল এক সের থেকে সোয়া সের। ক্রেতাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কেটে কেটে এই সাবান বিক্রি হতো। সেই সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রফতানি হতো এই সাবান। এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে হাতে তৈরি সাবান। এভাবে আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে এসব পেশা হারিয়ে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ : তাহলে তো পেশার রূপান্তরও হচ্ছে?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : তখনও রেডিও কিংবা টেলিভিশন আসেনি। ওই সময় ‘বায়োস্কোপ’ নামে একটি পেশা ছিল। বায়োস্কোপে গানের ছন্দে ছন্দে ছবি দেখানো হতো। ক্লাউনের মতো পোশাক ও মাথায় টুপি পরে গানের ছন্দ ধরতেন বায়োস্কোপওয়ালা। তখন কাচের বক্সের মধ্যে চোখ লাগালে ছবি দেখা যেত। এখনকার আধুনিক যুগে সেই বায়োস্কোপ দেখা যায় না। সেই বায়োস্কোপওয়ালারা হারিয়ে গেছেন। আধুনিকতার সঙ্গে সে জায়গা টেলিভিশনের মতো দখল হয়ে গেছে।
আগে মাঝিরা বৈঠা বেয়ে নৌকা চালাতেন। এখন সে জায়গা দখল করেছে ইঞ্জিন বোট। বৈঠা এবং পাল তোলা নৌকার উপযোগিতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই মাঝিদেরও আর দেখা যায় না।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় বিদেশি পেশাজীবীদের সময়টা কেমন ছিল?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : মুঘলদের সঙ্গে ইরানিদের যোগাযোগ ছিল। ইরানিরা ওই সময় এদেশে চশমা বিক্রি করতেন। এরপর আফগানিস্তান থেকে কাবুলিওয়ালার এলেন। তারা বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি সুদে টাকাও দিতেন। কাবুলিওয়ালারা ঈদের দিন ঢাকায় তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টায় অনুষ্ঠান করতেন। ধীরে ধীরে সেই কাবুলিওয়ালারাও চলে যান। বিশ শতকে এসে তাদের আর দেখা যায় না।
জাগো নিউজ : পেশা ধারণার উৎপত্তিটা কীভাবে?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : মানবসভ্যতার শুরুতেই পেশা ধারণার উৎপত্তি। এরপর নগর সভ্যতার শুরুতে নদীর তীরে কৃষিভিত্তিক জীবনযাপন শুরু হয়। তখন কৃষিকে অবলম্বন করে পেশার শ্রেণি বিভাগ শুরু হলো। ফসল উৎপাদনে সরাসরি কাজ করতেন কৃষকরা, সেচের জন্য আলাদাভাবে একটা অংশ কাজ করত। আবার কৃষি সরঞ্জাম তৈরির জন্য কারিগর শ্রেণির জন্ম হলো, তারা যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করলেন। এরপরই বাণিজ্যের প্রসার হলো এবং পেশাগুলো বড় হতে থাকল। সভ্যতার নানামুখী বিকাশের সঙ্গে পেশারও বিকাশ ঘটেছে এবং ঘটছে।
জাগো নিউজ : পেশা এভাবে বিলুপ্তির কারণ কী?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : সময়ের কারণে ধাপে ধাপে পেশার পরিবর্তন হচ্ছে। জোর করে বা ষড়যন্ত্র করে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে তা কিন্তু নয়। বিকল্প পেশা এসে শক্তভাবে জায়গা দখল করাই এমনটা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
জাগো নিউজ : এসব পেশার অনেকেই তো আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। এই পেশা ধরে রাখা বা সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি কি-না?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : হারিয়ে যাওয়া পেশা নতুন করে চালু করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্যের খবর রাখা জরুরি। ঐতিহ্য সবসময় ধারণ করতে হয়। আমাদের পূর্বসূরিরা কতটা এগিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের কতটা কৃতিত্ব ছিল তা পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে হবে। এটি মিউজিয়াম আকারে হলেও রাখতে হবে। তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম এগুলো বুঝতে পারবে।
ইংল্যান্ডের ডারহামে একটি গ্রাম দেখেছি, যেখানে আজও পুরোনো ঐতিহ্য অভিনব কায়দায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখানে তিনশ বছর আগের গ্রাম কেমন ছিল তা দেখানো হয়েছে। সেখানে কী কী ছিল, কী ধরনের পেশা ছিল তা জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের যে পেশাগুলো ছিল তা পরবর্তী প্রজন্মের জানানো এবং চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য পেশাকে নিঃশেষ হতে দেয়া যাবে না। এগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। ‘রিকনস্ট্রাকশনের’ মাধ্যমে তার ছাপটা ধরে রাখার জন্য হলেও কাজ করতে হবে।
ফারুক হোসাইন/এসআর/এএসএম