শেয়ারবাজার পুনরায় চালু হওয়া ও কিছু পরামর্শ

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:২৫ পিএম, ৩০ মে ২০২০

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দীর্ঘ ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পুনরায় চালু হতে যাচ্ছে। এটা খুশির খবর না দুঃখের খবর সে বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে একটা প্রশ্ন দিয়ে আজকের লেখা শুরু করতে চাচ্ছি তা হলো, এতদিন স্টক এক্সচেঞ্জ কেন বন্ধ থাকল?

অনেকেই এটার পক্ষে অনেক যুক্তি দেবেন। বলবেন, করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশে লকডাউন চলছে। কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাবে। যার দরুন কোম্পানির মুনাফাও সামনে হ্রাস পাবে। ফলে, এই সময় মার্কেট চালু রাখলে তা আরও পড়ে যেত। আমার প্রশ্ন হলো, এখন কি তাহলে কোম্পানির মুনাফা স্বাভাবিক হয়ে গেল যে, এখন মার্কেট চালু করলে শেয়ারের মূল্য পড়বে না?

বিশ্বের সব দেশ এই সময় মার্কেট চালু রাখল কেন? তাদের মার্কেট কি লকডাউনের কারণে প্রভাবিত হয়নি? তাদের মার্কেট কি আমাদের থেকে আলাদা? লকডাউনের কারণে প্রায় সব দেশের মার্কেটই প্রভাবিত হয়েছে। তারপরও তারা মার্কেট চালু রেখেছে, কিন্তু আমরা পারলাম না কেন? যা-ই হোক, এর ব্যর্থতা কমিশনের আগের ম্যানেজমেন্টকে অবশ্যই নিতে হবে।

মার্কেট পুনরায় চালু হওয়ায় একপক্ষ বিশেষ করে যারা এই মার্কেটে জব করেন এবং যারা এই মার্কেট থেকে অস্বাভাবিক গেইন করতে পারেন তারা খুব খুশি হয়েছেন। অপরদিকে, আর একপক্ষ খুব বেশি খুশি হতে পারছেন না, বরং তারা দুশ্চিন্তায় আছেন। কারণ মার্কেট চালু হলে হয়ত তারা তাদের পুঁজি আরও হারাতে পারেন। এখন মার্কেট চালু করলে মার্কেট পড়ে না গেলেও বাড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বস্তুত, এই মহামারির সময় মার্কেট বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণও নেই।

কমিশনের বর্তমান ম্যানেজমেন্ট হয়ত জেনেশুনেই মার্কেট চালুর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মার্কেটকে পুনরায় চালু করা কমিশনের নতুন ম্যানেজমেন্টের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ওনারা চ্যালেঞ্জটা নিয়েছেন এজন্য অভিনন্দন। তবে, যেহেতু মার্কেট বন্ধ ছিল এবং সময়টাও প্রতিকূল, সেহেতু আর একটু সময় নিয়ে পরিকল্পনা করে কিছু মেজারস্ নিয়ে চালুর সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো।

যা-ই হোক, এখন এক্সচেঞ্জ ও কমিশনের বর্তমান ম্যানেজমেন্টের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা, যদিও এটি খুব কঠিন হবে। এক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ ও কমিশন উভয়কে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সততা— এই তিন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মার্কেটকে মানিপুলেট করে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন তাদের স্বার্থ হাসিল করতে না পারে সে বিষয়েও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

এক্সচেঞ্জ ও কমিশনের কাছে আমার কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আছে যা মার্কেট চালুর আগে ওনারা ভেবে দেখতে পারেন।

১) পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে শুধু ভালো মৌলভিত্তিক শেয়ারের (এ ও বি ক্যাটাগরির) ট্রেডিং চালু করা যেতে পারে। এটা সফল হলে আস্তে আস্তে অন্য ক্যাটাগরির শেয়ারের ট্রেডিংয়ের অনুমতি দেয়া যেতে পারে।

২) মার্কেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে স্টক এক্সচেঞ্জ নতুন সার্কিট ব্রেকার (সর্বনিম্ন মূল্য) বেঁধে দিয়েছিল যাতে শেয়ারের মূল্য যেন পড়ে না যায়। এটা আপাতত বাতিল করার দরকার নেই। তবে সর্বনিম্ন মূল্য যেন এনএভি বা অভিহিত মূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। আমার মনে হয় এটা করাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে।

৩) বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানি মার্কেট ও ক্যাপিটাল মার্কেট পরস্পর সম্পর্কিত। বিশেষ করে ক্যাপিটাল মার্কেট মানি মার্কেটের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালে আমাদের স্টক মার্কেটের ধসের জন্য মানি মার্কেটের সমন্বয়হীন বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়ে থাকে। কমিশনের নতুন ম্যানেজমেন্টকে অবশ্য এই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং কীভাবে মানি মার্কেট ও ক্যাপিটাল মার্কেটের নীতিমালার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটানো যায় সে বিষয়ে কাজ করতে হবে।

৪) সার্ভিলান্স ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। পুঁজিবাজারে বিচারহীনতার সংস্কৃতি খুব বেশি, এটাকে ভাঙতে হবে।

৫) আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে ভালো কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন খারাপ কোম্পানি অনুমোদন না পায় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। বিগত কয়েক বছর আইপিও নিয়ে যেসব অনিয়ম হয়েছে তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। এসব অনিয়ম বিনিয়োগকারীর অস্থাকে নষ্ট করে। এখনও দেশি-বিদেশি অনেক ভালো কোম্পানি আছে, তাদের মার্কেটে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। মার্কেটে ভালো কোম্পানির সংখ্যা বেশি না হলে মার্কেটকে স্থিতিশীল করা কখনই সম্ভব হবে না।

৬) ইনসাইডার ট্রেডিং এবং নিউজ বা রিউমারভিত্তিক ট্রেডিংকে থামাতে হবে। যদিও এটা কঠিন হবে, কিন্তু আইন করে হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক এটাকে থামাতে হবে। এটার জন্যই আমাদের মার্কেট বেশি অস্থিতিশীল হয়।

৭) বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে যা বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগছে না। কাজেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এ বছরও রাখা যেতে পারে। এতে পুঁজিবাজার কিছুটা হলেও লাভবান হবে।

সর্বোপরি, মার্কেটকে স্থিতিশীল করতে কমিশনের দক্ষ ও সৎ লোকবল দরকার যা এই বর্তমান কমিশনের আছে বলে আমি মনে করতে চাই। মার্কেট ও নতুন কমিশনের জন্য শুভ কামনা করে আজকের লেখা শেষ করতে চাই।

ড. মো. বখতিয়ার হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।