স্বাভাবিক নিয়মে ব্যবসা চাই, চালান শেষ হলে খাব কী?
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চান তারা। এজন্য স্বাভাবিক নিয়মে দোকানপাট, বিপণি-বিতান ও শপিংমল খোলা রাখতে চান ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার এই মহামারির কারণে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন দোকান, বিপণি-বিতান ও শপিংমলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এসব প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এখন ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চান এসব ব্যবসায়ী। কিন্তু বিকাল ৪টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে। ফলে ঠিক মতো বেচাকেনা করতে পারছেন না তারা। চাহিদা অনুযায়ী কেনাকাটা করতে পারছেন না ভোক্তারাও।
ব্যবসায়ীরা জানান, সব অফিস স্বাভাবিক নিয়মে খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দোকানপাট খোলা ও বন্ধের ক্ষেত্রে শর্তারোপ করা হয়েছে। বেঁধে দেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট সময়। সরকারি-বেসরকারি অফিস বেশির ভাগই বিকাল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে ছুটি হয়। চাকরিজীবীরা অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার পথে কেনাকাটা করেন। বিকাল ৪টায় দোকান বন্ধ করায় তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারছেন না। অন্যদিকে বিক্রেতার অধিকাংশ পণ্যই অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। তাই করোনাকালে ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে স্বাভাবিক সময়ের মতো ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ চান তারা।
‘দীর্ঘদিন ব্যবসা বন্ধ, চরম ক্ষতির মুখে পড়েছি। চালানের টাকা দিয়ে এতদিন সংসার চালিয়েছি। এখন যদি চালানই না থাকে ব্যবসা করব কী দিয়ে? সঙ্গে রয়েছে কর্মচারীদের বেতন— এসব দুশ্চিন্তায় এখন হিমশিম খাচ্ছি। করোনায় নয়, মনে হয় মানসিক চাপেই মরে যাব। আমরা তো ছোট ব্যবসায়ী, এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। আমাদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে না। হয়রানিমুক্ত ব্যবসার সুযোগ দিলেই হবে’— বলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
সরকারের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনার প্রাদুর্ভাব রোধে বর্তমানে সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত দোকানপাট, বিপণি-বিতান ও শপিংমল খোলা রাখা যাবে। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিক্রি ও ক্রেতাদের সুবিধার্থে সারাদিন এসব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে চান ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর মুগদার মুদি ব্যবসায়ী আল-আমিন বলেন, বিকাল ৪টা বাজলেই পুলিশ এসে দোকান বন্ধ করতে বলে। মোদির মাল সাধারণত বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বেশি বিক্রি হয়। এখন ৪টায়-ই দোকান বন্ধ করতে হয়। ফলে মূল বেচাবিক্রি হচ্ছে না। সারাদিনে যে বিক্রি হয় তাতে অর্ধেক মালই পড়ে থাকে।
‘সরকার সবকিছু খুলে দিয়েছে। অফিস-আদালত স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। দোকানপাট কেন সীমিত পরিসরে হবে? এটার পরিবর্তন হওয়া উচিত।’
নবাবপুরের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী রাকিব জানান, দুই মাস বন্ধ ছিল দোকান। এক টাকাও ইনকাম হয়নি উল্টো খরচ হয়েছে। এখন খুলছি, তাও সীমিত সময়ের জন্য। ৪টা বাজলেই বন্ধ করতে হচ্ছে। দোকান খোলা থাকলে পুলিশ এসে ঝামেলা করে। বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হয়।
‘দুই মাসে যে ক্ষতি হয়েছে, পথে বসার মতো অবস্থা। এখনও কোনোমতে টিকে আছি। তবে এখন যদি ঠিকমতো ব্যবসা করতে না পারি তাহলে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। মাজা একেবারেই ভেঙে যাবে। এতদিন দোকান বন্ধ থাকলেও কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল কিন্তু মাফ হয়নি। ঠিক-ই তা পরিশোধ করতে হয়েছে। অন্যদিকে সংসারের খরচ তো থেমে নেই। খরচের সব পথ খোলা থাকলেও ইনকামের পথ কিন্তু বন্ধ। আমরা ছোট ব্যবসায়ী, এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। সরকারের কোনো আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। আমাদের ব্যবসা আমাদের করতে দিলেই হবে।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। জানান, সকাল ৮টায় অফিসের উদ্দেশে ছুটতে হয়। সেসময় বাজারের চিন্তা মাথায় থাকে না। অফিস শেষে বিকালে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করি। কিন্তু এখন অফিস ছুটির পর দেখি, সব দোকানপাট বন্ধ। নিত্যপণ্য কেনাকাটায় সমস্যা হচ্ছে। এসব দোকান বন্ধের সময়সীমা বাড়ালে সরকারের তেমন ক্ষতি হবে না। কারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমরা কেনাকাটা করছি।
এদিকে ইসলামপুরের কাপড়-ব্যবসায়ী সুমন জানান, এ বছর কোনো ব্যবসাই হলো না। সারা বছরের বেচাকেনা ঈদুল ফিতরকে ঘিরে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এবার কোনো বেচাবিক্রি হয়নি। পাইকারি ব্যবসা তো একবারেই শেষ। এখন কিছু খুচরা মাল বিক্রি করছি। একদিকে করোনার ভয় অন্যদিকে বিকাল ৪টার মধ্যে দোকান বন্ধ করতে হয়। ফলে কাস্টমার নাই। এমনও দিন যাচ্ছে, সারাদিনে এক হাজার টাকাও বিক্রি হয় না। অথচ ভাড়াসহ দোকানের খরচ প্রতিদিন তিন হাজার টাকা গুনতে হয়।
‘এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা করা আর সম্ভব হবে না। মহামারির কারণে এই সমস্যা, এটা তো আমরা মেনে নিয়েছি। এখন তো পরিবার-পরিজন নিয়ে আমাদের টিকে থাকার প্রশ্ন। জমানো টাকা শেষ, চালানে হাত দিয়েছি। চালান শেষ হলে করব কী? সরকারকে তো আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান চালাতে চাই, সেই সুযোগ তো দিতে হবে। তা না হলে টিকে থাকাই মুশকিল। আমরা ব্যবসা করতে না পারলে ট্যাক্স দেব কীভাবে? ট্যাক্স না পেলে সরকার চলবে কীভাবে?
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুর রহমান টিপু জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলো বেশির ভাগই বিকাল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে ছুটি হয়। চাকরিজীবীরা অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় কেনাকাটা করেন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের ৪টার মধ্যে দোকান বন্ধ করতে হয়। যে কারণে আমাদের বেচাকেনা হচ্ছে না। সরকারের প্রতি আমাদের আবেদন, অন্তত অফিসফেরত লোকজন কেনাকাটার সুযোগ পাক; সেই ব্যবস্থা করা হোক। এতে আমরাও বাঁচব, চাকরিজীবীরাও প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারবেন।
‘এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা আমাদের সমস্যার কথা জানিয়েছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এখন সরকারের পক্ষ থেকে কী সিদ্ধান্ত আসে, সেটা-ই দেখার বিষয়।’
এসআই/এমএআর/জেআইএম