শিক্ষা বাজেটে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ দেখতে চান না শিক্ষাবিদরা
আসছে অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষা বাজেটে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ থেকে সরে আসার আহ্বান জানান তারা। বাজেট ব্যবস্থাপনায় অর্থব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ানো এবং অর্থের ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতেরও দাবি জানান তারা।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। এবার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার মেগা বাজেট ঘোষণা হবে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মধ্যেই এদিন বিকেলে বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
আগামী অর্থবছরের জন্য শিক্ষা বাজেট কেমন হওয়া উচিত, কোন কোন বিষয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন, শিক্ষা বাজেটের রূপরেখাই-বা কেমন হওয়া উচিত— এমন আরও বিষয় নিয়ে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ দেয়া উচিত। বিগত দুই দশকে শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের যে অগ্রযাত্রা তা সমুন্নত রাখতে এবং করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখনই একটি শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম হাতে নেয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, করোনার সরাসরি প্রভাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রেণিকক্ষ-ভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সরকার এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইলফোন ও ইন্টারনেট-ভিত্তিক শিক্ষাকর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও এ মাধ্যমে এখনও সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
শিক্ষা পুনরুদ্ধারে বিশেষ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনাঝুঁকি প্রশমন ও এডুকেশন রিকভারি কার্যক্রমের আওতায় বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ কমপক্ষে দুই-তিন বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। ওই বিশেষ পরিকল্পনায় পাঠদান, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া, শিক্ষক ও অভিভাবকদের আশ্বস্ত করা, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো বাদ দেয়া এবং পাঠদানের রুটিন সমন্বয় করা প্রয়োজন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বাজেটে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া থেকে সরে আসতে হবে। শিক্ষা বাজেটের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও বিভিন্ন প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদাভাবে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।
তিনি বলেন, করোনা-পরিস্থিতির পরে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। কিন্তু নতুন বাজেটে সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না বলে মনে করি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের সহায়তা ও প্রণোদনা, স্থানীয় পরিকল্পনা ও জনঅংশগ্রহণ, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা গবেষণার প্রসার, বাজেট বরাদ্দ ও বাজেট ব্যবহারের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, ন্যূনতম শিখন ফল অর্জনে বিশেষ উদ্যোগ এবং সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় বিশেষ উদ্যোগের বিষয়ে বাজেটে গুরুত্ব দিতে হবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক একরামুল কবির বলেন, গত অর্থবছরের চাইতে এবার শিক্ষা খাতে বাজেটে বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। গত বছরের মতো বাজেটের আকার হলেও কমপক্ষে শিক্ষায় জাতীয় বাজেটের আড়াই শতাংশ আর মোট বাজেটের ১২ থেকে ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া উচিত। তবেই মানসম্মত শিক্ষা দেয়া সম্ভব।
‘শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনবাবদ অর্থব্যয় বেশি হয়। প্রতি বছর তাদের বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বরাদ্দ না বাড়ালে শিক্ষার উন্নয়নমূলক কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। শিক্ষার বাজেটে শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে সরে এসে আলাদাভাবে বরাদ্দ দিতে হবে। অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমকে সকলের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে এ খাতে বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।’ এসব বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যয় এবং সবকিছু জবাবদিহিতার মধ্যে আনার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দেন এই শিক্ষাবিদ।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ ৭৯ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা দেয়া হয় এই খাতে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাজেটের শিক্ষা খাতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ‘শিক্ষা ও প্রযুক্তি’ খাতটি সর্বাধিক বরাদ্দ পায়।
তবে প্রযুক্তি খাত বাদ দিলে শুধু শিক্ষা খাতের ব্যয় দাঁড়ায় ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, যা বাজেটের সাড়ে ১১ শতাংশের মতো। এতে দ্বিতীয় স্থানে নেমে যায় শিক্ষা খাত। অন্যদিকে, ৬৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে শীর্ষে উঠে যায় পরিবহন ও যোগাযোগ খাত।
এমএইচএম/এমএআর/এমএস