মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা নিয়ে ‘এবং প্রমিলা’ আদালতে প্রদর্শন

হাসিনা সাফিনা বানু (উর্মি) আরণ্যক নাট্যদলে কাজ করছেন দীর্ঘসময় ধরে। এই দলের একাধিক নাটকের অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত তিনি। তবে এবার তার একক অভিনয়ের নাটক নিয়ে মঞ্চে হাজির হলেন হাসিনা সাফিনা বানু। তাও দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে সন্ধ্যায় তার একক অভিনয়ে সপ্তর্ষি নাট্যদলের প্রথম প্রযোজনা ‘এবং প্রমিলা’ আখ্যান।
‘এবং প্রমিলা’ নাটকটি স্বাধীনতা যুদ্ধে পতিতাপল্লির নারীদের ত্যাগের বিষয় অবলম্বন করে তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতা মুক্তিযুদ্ধের অনালোকিত অধ্যায় সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। সব শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে সপ্তর্ষির প্রথম প্রযোজনা ‘এবং প্রমিলা’।
নাটকটি মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের শহীদ সফিউর রহমান মিলনায়তনে সন্ধ্যায় মঞ্চায়ন হয়। নাটকটির মূল ভাবনা, গবেষণা ও একক অভিনয়ে হাসিনা সাফিনা বানু উর্মি। নাট্যরূপ অধ্যাপক আব্দুস সেলিমের। নির্দেশনা দিয়েছেন জুলফিকার চঞ্চল।
নাটকটির আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন মোখলেছুর রহমান, সংগীত পরিকল্পনায় উচ্ছাস কুমার ঘোষ, মঞ্চ পরিকল্পনায়, সার্বিক সহযোগিতায় অ্যাডভোকেট কে এম সাইফুদ্দীন আহমেদ, পোস্টার ডিজাইন হাশিম মাসুদ ও মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন জুবায়ের জাহিদ।
‘এবং প্রমিলা’ নাটক প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার মো. কোবাদ হোসেন জানান, নাটকের গল্পটাই উঠে এসেছে একজন অপসারিণীর জীবন বৃত্তান্ত থেকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রমিলার অবদান সমাজের কাছে ‘বীরাঙ্গনা’ নাকি ‘বারাঙ্গনা’ পরিচয় বহন করবে-এমন একটা প্রশ্নের মধ্যে উর্মি অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন।
হাসিনা সাফিনা বানু (উর্মি) বলেন, বেশ কয়েক বছর ‘এবং প্রমিলা’ নাটকের পটভূমিটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অসংখ্য পতিতালয়ের নারীদের কি ভূমিকা ছিল সে বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে অবশেষে দেশের একটি পতিতালয়ে সরেজমিনে দেখে এসে এ নাটকের মূল ভাবনাটি লিখি।
লেখাটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রয়াত নাট্যজন শ্রদ্ধেয় মান্নান হীরা নাটকটি রচনা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন; কিন্তু কাজটি শুরু করার আগেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক আবদুস সেলিম নাটকটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেন।
নাটক মঞ্চায়নের সময় উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নুর দুলাল, অভিনেত্রীর বাবা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অ্যাডভোকেট কে এম সাইফুদ্দীন আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান, অ্যাডভোকেট এসএম আবুল হোসেন ও অ্যাডভোকেট সাগর আনোয়ার।
এর আগে আওয়ামীলীগের ইতিহাস ও বাঙালি ও বাংলাদেশ প্রযোজনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রে উর্মি অভিনয় করেন। যা প্রধানমন্ত্রী দেখেন এবং প্রশংসা করেন বলে জানান তিনি।
নাটকের ঘটনা অবলম্বনে জানা যায়, অন্ধকার মঞ্চে আলো জ্বলতেই দেখা যায় ক্ষীণ পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন এক নারী। ৭১ বছরের এই ওই নারী দ্বারে দ্বারে ধরণা দিচ্ছেন, কারণ তার একটি সার্টিফিকেট লাগবে। কিন্তু কেউ সেটার গুরুত্ব না দিয়ে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। একসময় তিনি ডিসি সাহেবের অফিসে যান, খুবই অনুনয় করে ডিসি সাহেবকে জানান, তার একটি সার্টিফিকেট দরকার। ওই নারীকে দেখে ডিসি সাহেব বলেন, আমি আপনাকে অবশ্যই সার্টিফিকেট দেব কিন্তু আপনার সার্টিফিকেটের বিষয় কী হবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘একটা সরকারি কাগজে লিখে দেন যে আমি মইরা গেছি। তারপর ওই সার্টিফিকেটটা গোয়ালন্দের ৬ নম্বর ঘাটের সবাইরে দিমু।’ ১৯৭১ সাল আর ৭১ বছর বয়সী প্রমীলা- এখান থেকেই শুরু হয় ‘এবং প্রমীলা’ নাটকের মূল গল্প।
গোয়ালন্দ ঘাটের যৌনপল্লিতে বড় হওয়া প্রমীলা-আমাদের সমাজের কোনো এক অভাগা নারীর নিষিদ্ধপল্লির রানী হয়ে ওঠার গল্প। নিজের অনিচ্ছায় প্রতি রজনী অন্যের শারীরিক সুখের সামগ্রী হওয়া এবং ক্রমাগতভাবে ভোগের উপকরণ হয়ে ওঠা। দশটা নারীর মতো মাতৃত্বের স্বাদ পেলেও আপন সন্তানকে বুকে নিতে পারেননি।
কারণ যৌনকর্মীদের শরীর বিক্রি করাই প্রধান কাজ, সন্তান পালন নয়। গর্ভফুল থেকে ছিঁড়ে বের করে নেওয়া সন্তান কোথায় আছে প্রমীলা জানেন না। ঘুঙুর বাঁধা পা ঘুঙুরের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে হৃদয়ের রক্তক্ষরণের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সবার অগোচরে। জীবন থেমে থাকে না, চলে বহতা নদীর মতো।
ক্ষুধার জ্বালা আর বেঁচে থাকার তাগিদে জীবন চলে জীবনের গতিতে। এরই মাঝে আসে স্বাধীনতার ডাক। রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানের নরপিশাচের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার নিরীহ মানুষের ওপর। তার ছোবল পড়ে গোয়ালন্দ ঘাটের যৌনপল্লিতেও।
যে যেভাবে পারে পালিয়ে যেতে থাকে প্রাণ বাঁচাতে। প্রমীলাও তার মাসির সঙ্গে শেষ সম্বলটুকু হাতে নিয়ে পালাতে থাকেন, কিন্তু পারেন না। অন্তঃক্ষরণ- দেশকে বাঁচাতে হবে। ফিরে যান আবার যৌনপল্লিতে। গিয়ে দেখেন এক নরকযজ্ঞ ঘটে গেছে যৌনপল্লিতে।
এটি হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি সেনাদের আবাসস্থল আর নিরীহ মানুষকে অত্যাচারের টর্চার সেল। প্রমিলা ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশ রক্ষার কাজে। বুদ্ধি করে পাকিস্তানি সেনাদের আস্থা অর্জন করে প্রতি রাতে একেক সেনার শয্যাসঙ্গিনী হয়ে ওঠেন। মাঝে মাঝে অত্যাচারিত নিরীহ মানুষকে সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে উদ্ধার করেন আর বাঁচান শত শত নিরীহ নারীর ইজ্জত। অস্ত্র হাতে নিয়ে নয়, নিজের শরীরটাকে অস্ত্র বানিয়ে খতম করতে থাকেন একেকজন পাকিস্তানি সেনাকে। এভাবেই যুদ্ধ একদিন শেষ হয়।
রাস্তার ধারে ক্ষীণ হয়ে আসা চোখের দৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে ভেসে ওঠে অতীতের দিনগুলো। কর্মক্ষমতাহীন তার দৃষ্টি আর ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। যেখানেই যান দূর দূর করে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেয় এই সভ্য সমাজের মানুষ। জীবনের প্রতিটি বাঁকে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে বর্তমানে প্রমীলার একমাত্র আরাধ্য একটি মৃত্যুর সার্টিফিকেট।
মঞ্চে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে হাসিনা সাফিনা বানু উর্মি এমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভিনয় করেছেন ‘এবং প্রমীলা’ নামে একক অভিনয়ের এই নাটকটিতে।
কয়েক দশক ধরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একক অভিনয়ের নাটক দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ‘এবং প্রমীলা’ নাটকটি নবতর সংযোজন। হাসিনা সাফিনা বানু উর্মির অভিনয় হৃদয় ছুঁয়ে গেছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও আইনজীবীদের মন।
এফএইচ/এমএমএফ/এমএস