সাংবাদিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছেন

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:০৯ পিএম, ১৫ জুলাই ২০২০

ফাল্গুনী রশিদ ৯ বছর ধরে একাত্তর টিভিতে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে একটি বাংলা এবং ইংরেজি সংবাদপত্রেও কাজ করেছেন। সম্প্রতি করোনাভাইরাস বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছেন খুব কাছ থেকে। কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। উর্মিলা সরকার-কে জানিয়েছেন তার সেই অভিজ্ঞতার গল্প।

করোনাসংশ্লিষ্ট খবর সংগ্রহের দায়িত্ব পেয়ে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
- প্রথমদিকে তো হাসপাতালের ভেতরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তখন বাইরে থেকে নিউজ কাভার করেছি। করোনা রোগীর দাফনসংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন করার জন্য খিলগাঁও কবরস্থানে গিয়েছি। পরবর্তীতে হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে যখন নিউজ কাভার করেছি; তখন প্রায় সব হাসপাতালেই করোনা রোগীর সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। আমি ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং মুগদা হাসপাতালে গিয়ে প্রতিবেদন করেছি।

আসলে নিউজরুমগুলোতে কোনো সাংবাদিককে দায়িত্ব দেওয়ার আগে আমাদের সাথে আলোচনা করেই কাজ বণ্টন করা হয়। আমি নিজ উদ্যোগেই আমার অফিসকে বলেছিলাম যে, শিশু হাসপাতাল এবং কবরস্থানের চিত্র তুলে ধরার জন্য আমি সেখানে যেতে চাই। এখানে আমাকে কেউ চাপিয়ে দেয়নি। আমি নিজেই কাজের পরিকল্পনা করে কাজ করেছি। আমি খুব বেশি ভয় পাইনি। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেলে একধরনের লাইভ প্রোগ্রাম সম্প্রচারের প্রতিযোগিতা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে অফিস আমাকে হয়তো দু-একটি লাইভ করার অনুরোধ করেছে, কিন্তু আমি স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে লাইভ সম্প্রচারের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছি।

কারণ লাইভ রিপোর্ট সম্প্রচার করতে হলে আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসপাতালে থাকতে হবে। যেটা আমার কাছে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে। বাংলাদেশে এই ভাইরাস আক্রমণের আগে বিশ্বের অনেক দেশেই এটি ছড়িয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়ালেও আমাকে কাজ করতেই হবে। আমি আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে, এ দুর্যোগের মধ্যেই আমাকে কাজ করতে হবে। সব ধরনের সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে আমি কাজ করে যাচ্ছি।

আপনি যখন জানতে পারেন আপনার কোনো সহকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তখন আপনার কী মনে হয়?
- প্রথমেই যখন টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে ইনডিপেনডেন্ট টিভির একজন সাংবাদিক আক্রান্ত হলেন; তখন একটু ভয় পেয়েছিলাম। তারপর যখন ধীরে ধীরে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হওয়া শুরু করল; তখন মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ কোনো না কোনো সাংবাদিক তো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেই। তখন খুব বেশি ভেঙে পড়িনি। কিন্তু যখন আমার নিজের চ্যানেলে কেউ আক্রান্ত হলেন; তখন আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি কেন হলো? কোন দিকগুলোতে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। সর্বোপরি আমাদের যেসব সহকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, আমি সব সময় তাদের মানসিকভাবে সমর্থন দিয়েছি। কিন্তু খুব একটা থমকে যাইনি। কারণ কোনো চিকিৎসা নেই, ওষুধ নেই, ভ্যাকসিন নেই।

করোনাভাইরাস নিয়ে নিউজ কাভার করতে গিয়ে আপনি কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন?
- কাজের জন্য এখন সব জায়গায় সশরীরে যাওয়া যাচ্ছে না, এটি একটি সীমাবদ্ধতা। আমাদের ‘নিউ নরমাল’ সিস্টেমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে। যেমন- অনলাইনে ইন্টারভিউ নেওয়া। আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিচালিত স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রচারের সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে পারতেন, এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। পারিবারিক জীবনে নিজেকে একটু আলাদা বা দূরে রাখতে চাইলে, তা করতে পারছি না। যেমন- কিছুদিন আগে আমার বাচ্চা যেন সংক্রমিত না হয়, সে শঙ্কা থেকে বাচ্চাকে মায়ের বাসায় রেখে এসেছি। যেহেতু আমি হাসপাতালে যাই। বাচ্চার কাছাকাছি থেকেও দেখা না করার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলাম না। এমনকি এখনো কাজ থেকে বাসায় ফিরে সব কিছু পরিষ্কার করে তারপর বাচ্চাকে নিজের বাসায় আনি।

করোনাকালে আপনার পরিবার আপনার পেশাকে কীভাবে দেখছেন?
- আমার পরিবারের সদস্যরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। যেহেতু আমি দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা পেশায় আছি। কাজেই করোনা বা যেকোনো দুর্যোগে আমাকে যে কাজ করতেই হবে- এটি তারা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। আমার মা আমাকে সব সময় সহযোগিতা করছেন। যেমন- আমার বাচ্চাকে রাখা, অফিসে যাওয়ার সময় আমার দুপুরের খাবার তৈরি করে দেওয়া এমনকি মাঝে মাঝে রাতেও আমার বাচ্চাকে আমার মায়ের কাছে রাখছেন।

এভাবে কাজ করে যাওয়ার পেছনে আপনাকে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিচ্ছে?
- আমার মনে হয়, এরকম নতুন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আগে কখনো যায়নি। সবাই অনেক ভাবে চিন্তা করছেন। করোনাকালীন বহুমাত্রিক নিউজ করার সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন উপায়ে করোনা মোকাবিলার যে চেষ্টা; সেটা নিউজের মাধ্যমে দেখাতে পারি, বলতে পারি। ফলে এটাকে কাজ করার উপযুক্ত সময় বলে আমার মনে হয়েছে। মোট কথা, সময়টি বসে থাকার নয়। সাংবাদিকতার জন্য এটি একটি ভালো সময়। এটাই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমি অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি সময়টির সাথে। প্রথমদিকে একটু ভয় লাগত। কিন্তু ধীরে ধীরে যেভাবে প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এখন আর আতঙ্ক লাগে না। কারণ নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তারপরও যদি করোনা আক্রান্ত হই, তাহলে মানসিকভাবে চাঙা বা শক্ত থাকতেই হবে। যেটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

আপনার কোনো সহকর্মী করোনা রিলেটেড দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন?
- আমি মনে করি, যদি কেউ এ সময় দায়িত্ব পালনে আপত্তি জানায়- এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যদি মনে করেন যে তিনি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন, তাহলে তিনি আপত্তি জানাতেই পারেন। এখানে কেউ কাউকে বাধ্য করতে পারেন না। কারণ যতই সুরক্ষা নেওয়া হোক না কেন, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হবেন না- এ নিশ্চয়তা কিন্তু কেউ দিতে পারবেন না। যেসব অফিস এ ব্যাপারে প্রতিবেদকের নিজের মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে- আমি মনে করি সেটা ইতিবাচক দিক। আমি কোনোভাবেই এসব ঘটনা শুনে নিরুৎসাহিত হইনি। আমি যখন করোনা রোগীর দাফন নিয়ে প্রতিবেদন করতে যাচ্ছিলাম, আমার একজন সহকর্মী কিছুটা শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু তাতে আমি একটুও নিরুৎসাহিত হইনি। আমি মনে করি, এ ক্রান্তিকালে একজন রিপোর্টারের নিজের মতামতের স্বাধীনতা থাকা উচিত। আমাদের অফিস থেকে কাউকে বাধ্য করেনি কাজ করার জন্য।

সাংবাদিকরা এ সময়ে কোনো ইনসেনটিভ বা স্পেশাল বোনাস ডিজার্ভ করে?
- অবশ্যই সাংবাদিকদের বিশেষ প্রণোদনা পাওয়া উচিত। আসলে সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকিভাতার বিষয়টি কিন্তু আজকে নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকদের ঝুঁকিভাতা তো দূরের কথা, প্রভিডেন্ট ফান্ডও নেই। যেটা তাদের অবসর জীবনের শেষ সম্বল হতে পারত। কোনো কোনো মিডিয়া হাউসে তো কর্মীরা নিয়মিত বেতনও পান না। পত্রিকাগুলো বিভিন্ন কারণে এখন আর্থিক সঙ্কটে আছে। ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক সবাই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। কিন্তু ডাক্তার, পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ ইন্স্যুরেন্স আছে। সেদিক থেকে সাংবাদিকদের জন্য কিছু নেই। এমনকি সাংবাদিক সংগঠনগুলোর খুব বেশি উদ্যোগও নেই এসব ক্ষেত্রে। তারা সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন প্রাপ্তির বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ঝুঁকিভাতার ব্যাপারে তারা কীভাবে কাজ করবেন! তারা এখনো সাংবাদিকদের মৌলিক বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংগঠন বা সরকার কীভাবে সহযোগিতা করছে?
- ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেএস) নামে একটি সেন্টার আছে। সংগঠনটি সব টেলিভিশন কর্মী, যেমন- সাংবাদিক থেকে প্রডিউসার, ক্যামেরাম্যান সবার জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে একটি বেসরকারি হাসপাতালের সাথে চুক্তি করেছে। যেখানে ৩৫টি আসন বরাদ্দ রাখা হবে টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মীদের জন্য। সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা যেন প্রয়োজনে চিকিৎসা নিতে পারি। সাংবাদিকদের করোনা পরীক্ষার জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে বিজেএস’র চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বুথে গিয়ে সাংবাদিকরা করোনা পরীক্ষা করাতে পারবেন। বুথ তৈরির জন্য উত্তর সিটি করপোরেশন একটি নির্দিষ্ট জায়গা দিয়েছে। যেখানে সাংবাদিকরা করোনা টেস্ট করাতে পারবেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) অনেক পত্রিকা এবং টিভির সাংবাদিকরা যুক্ত আছেন। সংগঠনটি তাদের নিজস্ব জায়গায় সাংবাদিকদের জন্য করোনা পরীক্ষার বুথ তৈরি করেছেন। দুটি টেস্টিং বুথে সাংবাদিকরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা করোনা পরীক্ষা করাতে পারবেন। করোনা পরীক্ষার কীটগুলো সরকার কর্তৃক প্রদান করা হয়েছে।

আপনার অফিস আপনাকে পিপিই এবং অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জামাদি দিয়েছে?
- হ্যাঁ। আমরা যখনই নিউজ কাভার করতে গিয়েছি; তখনই আমার অফিস থেকে পিপিইসহ অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জামাদি দেওয়া হয়েছে। এমনও হয়েছে, আমার পিপিই এসে পৌঁছায়নি। তাই হয়তো আমি আমার সে দিনের কাজ বাদ দিয়েছি। এখনো যখন হাসপাতালে যাই, অফিস থেকে সব সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া হয়।

লেখক: প্রকল্প কর্মকর্তা, সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর মিডিয়া ইন ডেভেলপমেন্ট (সাকমিড)

এসইউ/এএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।