ফিচার

প্রাসাদ থেকে জাদুঘরে শশীলজ

প্রাসাদ থেকে জাদুঘরে শশীলজ

তানজিদ শুভ্র

Advertisement

সব শহরেরই কিছু স্মৃতি থাকে, যা সময়ের কোল পেরিয়ে ইতিহাস হয়ে ওঠে। ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে, ব্রহ্মপুত্র নদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক নিদর্শন শশীলজ। শতবর্ষী এই প্রাসাদ শুধু একটি ভবন নয়, এটি এক সময়ের জমিদার শৌর্য-বীর্য, ব্রিটিশ আমলের রুচি ও শিল্পবোধের এক জীবন্ত দলিল।

ইউরোপীয় ধাঁচে নির্মিত এই প্রাসাদটির দেয়ালে, স্তম্ভে ও জানালায় শিল্পকলার ছাপ এতটাই নিখুঁতভাবে আঁকা, যা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।

মুক্তাগাছার জমিদার বংশের উত্তরসূরী মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী, নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি তার দত্তক পুত্র মহারাজ শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর নামে ময়মনসিংহ শহরে এই বিলাসবহুল প্রাসাদটি নির্মাণ করেন যার নামকরণ হয় ‘শশীলজ’। কথিত আছে, মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি থেকে সুড়ঙ্গপথ ছিল শশীলজ অবধি।

Advertisement

শুরুতে এটি ছিল দুই তলা ভবন, যার নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল প্যারিস ও ইউরোপের নানা স্থান থেকে আনা সৌখিন উপকরণ। এই স্থাপত্য শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, এটি এক সময়কার সমাজের রুচি, শৌর্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। মেঝেতে মার্বেল, ছাদে ঝাড়বাতি, জানালায় রঙিন কাঁচের পাত, আর ভেতরে ঝরনা ও বলরুম সব মিলিয়ে এক অপূর্ব অভিজাত্যতা। কিন্তু ১৮৯৭ সালের জুন মাসে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে এই প্রাসাদটি বিধ্বস্ত হয়।

পরবর্তীতে মহারাজ শশীকান্ত ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে ভবনটি নির্মাণ করেন। প্রায় ৯ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই প্রাসাদে প্রবেশপথেই রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলান যুক্ত একটি তোরণ। ভেতরে সবুজ লনের মাঝে মার্বেল পাথরের ঝবণা ও ভাষ্কর্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। ভবনের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি পুরোনো পুকুর, যার ঘাটে নির্মিত স্নানঘর আজও অতীতের শৌখিন জীবনের সাক্ষ্য দেয়।

অনন্য গঠনশৈলী ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে শশীলজ শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি ময়মনসিংহ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত এই জাদুঘরে জমিদার আমলের অনেক দুর্লভ নিদর্শন, শিল্পকর্ম ও ঐতিহাসিক উপকরণ সংরক্ষিত আছে। এখানে রয়েছে মুক্তাগাছা, গৌরপুর, আঠারোবাড়ি জমিদারবাড়ি ও নেত্রকোণার কেন্দুয়া এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। আছে অলংকরিক ইট, মিনাকৃতির ইট, টেরাকোটার টুকরো, বিষ্ণু মূর্তি, মারীচি মূর্তি ও মহাশ্রীধর মূর্তির মতো শিল্পিত প্রতিমা।

Advertisement

শুধু তাই নয়, সংগ্রহে রয়েছে ১৮-১৯ শতকের কাঠের সোফা, গোল টেবিল, খাট, হুক্কা, কলকি, কলমদানি, দোয়াত কলম রাখার পাত্র, প্রাচীন রামদা, বল্লম, বলছিরা, খড়গ, বাঘের মাথা, হরিণ ও মহিষের শিং, সুতা কাটার চরকা, হাত কাটার যন্ত্র, এমনকি সামুদ্রিক ঝিনুক পর্যন্ত। এক পাশে প্রদর্শিত হয়েছে মরিচা পড়া প্রাচীন সিন্দুক-১৮০০ থেকে ১৯০০ শতকের ঐতিহাসিক ছোঁয়া যাকে ঘিরে আছে।

সংগ্রহশালায় আছে শহীদ শিল্পী আব্দুর রশিদ থেকে প্রাপ্ত একটি চমৎকার ভাষ্কর্য-একটি মা-ছেলের মমতার দৃশ্য, যা ১৯৬০ সালের। রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা শৈল্পিক, নান্দনিক চিত্রকর্ম। এসব উপাদান যেন অতীতকে চোখের সামনে এনে দেয়। জাদুঘরের বাইরের দেয়ালে ময়মনসিংহ জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ছবি ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ ফ্রেমিং করে প্রদর্শন করা হয়েছে, যা স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়।

জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী খোলা থাকে। গ্রীষ্মকালে (১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দুপুরে ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত সামান্য বিরতি থাকে। শুক্রবারে খোলা থাকে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত। তবে রোববার পুরো দিন এবং সোমবার অর্ধদিবস জাদুঘরটি বন্ধ থাকে। এছাড়া অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনেও জাদুঘরটি সাধারণত বন্ধ থাকে। তবে বিশেষ সরকারি আদেশে কখনো কখনো খোলা রাখা হয়।

এই সময়সূচি মেনে যে কেউ চাইলে সহজেই শশীলজ পরিদর্শন করতে পারেন। জমিদার ইতিহাস, শৈল্পিক নির্মাণ আর অতীত ঐতিহ্যের অনন্য সাক্ষী হতে একদিনের জন্য হলেও ঘুরে আসা যায় এই শশীলজ থেকে।

আরও পড়ুন

চায়ের ইতিহাসে লুকিয়ে আছে শ্রমিকের নীরব কষ্ট সিলেটের মণিপুরী শাড়ি বাংলার নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয়

লেখক: শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর।

কেএসকে/এমএস