দেশজুড়ে

লবণ বিতরণের মহৎ উদ্যোগে জল ঢালছে স্বজনপ্রীতি

লবণ বিতরণের মহৎ উদ্যোগে জল ঢালছে স্বজনপ্রীতি

* বরাদ্দ বঞ্চিত ইসলামপুর শিল্প এলাকার শতাধিক লবণ মিল* দায় নিচ্ছে না বিসিক কিংবা বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি* মজুত করায় বাজারে কমেছে লবণ বিক্রি

Advertisement

‘চামড়ার হক যেন এতিম-দরিদ্রদের কাছে পৌঁছায়’-এই মহৎ উদ্দেশ্যে আসন্ন ঈদুল আজহায় দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে ৩০ হাজার মেট্রিক টন লবণ বিনামূল্যে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লবণ বিতরণ করা হবে দেশের বিভিন্ন এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে। লবণ মিল মালিকদের কাছ থেকে এসব লবণ সংগ্রহ করা হবে।

সরকারের নেওয়া এ উদ্যোগ মহৎ ও প্রশংসনীয়। কিন্তু বাস্তবায়নের আগেই এটি ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক, অসন্তোষ এবং জোরালো অভিযোগ। লবণ বিতরণের জন্য প্রস্তুত করা লবণ মিলগুলোর তালিকায় চরম বৈষম্য, পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতি লক্ষণীয়। এতে করে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশের লবণ উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র কক্সবাজারের ইসলামপুর শিল্প এলাকার শতাধিক লবণ মিল মালিক।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) গত ২৮ মে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একই মিলকে একাধিকবার তালিকায় স্থান দিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টন পর্যন্ত লবণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কেউ পেয়েছে ৫০-৬০ টন, কেউবা ৯০-১৩০ টন। কিন্তু অনেক পরিচিত, অভিজ্ঞ ও সচ্ছল লবণ মিল তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন- কোরবানির চামড়া সংগ্রহে গরম নিয়ে দুশ্চিন্তা উৎপাদন খরচও উঠছে না লবণ চাষিদের লবণ বেচে লোকসান

তালিকা থেকে বাদ পড়া মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইসলামপুরের ছেনুয়ারা সল্ট, সোনালি সল্ট, এসএস সল্ট, মজদিয়া সল্ট, সীরোজ সল্ট, কক্সবাজার সল্ট, সেন্টমার্টিন সল্টসহ অন্তত ৩০টি পুরোনো ও পরিচিত প্রতিষ্ঠান।

‘আমার গুদামে দেড় লাখ মণের বেশি লবণ মজুত রয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের মিলকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা চরম বৈষম্য ও অন্যায়।’

ছেনুয়ারা সল্টের মালিক মো. সরওয়ার আলম বলেন, আমার গুদামে দেড় লাখ মণের বেশি লবণ মজুত রয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের মিলকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা চরম বৈষম্য ও অন্যায়।

এসএস সল্টের স্বত্বাধিকারী তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইসলামপুরের বহু মিল বাদ পড়েছে, আবার কিছু মিলকে একাধিকবার তালিকাভুক্ত করে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটা পুরোপুরি প্রহসন।

Advertisement

এমনকি কক্সবাজারের অন্যতম প্রাচীন ও সুপরিচিত মিল ‘কক্সবাজার সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ’। যার মালিক কেন্দ্রীয় বিএনপির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল। সেই প্রতিষ্ঠানটিকেও রাখা হয়নি তালিকায়।

এদিকে ইসলামপুর মিল মালিক সমিতির সভাপতির নিজের মিলও তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।

সমিতির সভাপতি শামশুল ইসলাম বলেন, ইসলামপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের মিলগুলোকে এইভাবে বাদ দেওয়া অত্যন্ত অপমানজনক। এমনকি আমার নিজের একটি মিলও তালিকায় নেই। আমি বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবগত করেছি।

এদিকে বৈষম্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদত্যাগ করেছেন। সহ-সভাপতি মোহাম্মদ রেজুয়ানুল ইসলাম পদত্যাগপত্রে লেখেন, ‘সরকারের এই মহৎ উদ্যোগে যে বৈষম্য ও অনিয়ম প্রকাশ পেয়েছে, তা মেনে নেওয়া আমার বিবেকের পরিপন্থি। সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে থেকে নীরব থাকা সম্ভব নয়।’

অপরদিকে ‘ছেনুয়া ফজল আহমদ সল্ট ফ্যাক্টরি’র পরিচালক মীর আহমদ কার্যকরী সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে বলেন, ‘সরকারি লবণ বিতরণে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। আমি এটিকে নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে প্রতিবাদ হিসেবে দেখছি।’

‘সরকারের ঘোষণা বাজারে প্রভাব ফেললেও বরাদ্দ না পাওয়ায় বিপুল পরিমাণ লবণ গুদামে পড়ে আছে। ফলে ঈদের সময় সত্যিকারের চাহিদা মেটাতে সংকট তৈরি হতে পারে।’

অপরদিকে লবণ সংগ্রহের এই তালিকা কে প্রস্তুত করেছে তার দায় নিচ্ছে না বিসিক বা সমিতি কেউই। তালিকায় বৈষম্য নিয়ে যখন দেশের বৃহত্তম লবণ উৎপাদন এলাকা উত্তাল, তখন তালিকা তৈরির দায় একে অপরের কাঁধে চাপাচ্ছে বিসিক ও মিল মালিক সমিতি।

বিসিক কক্সবাজার লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, তালিকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি। আমরা কেবল তা প্রকাশ করেছি।

অন্যদিকে ওই সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বলেন, তালিকা তৈরি করেছে বিসিক। আমরা শুধু সমন্বয়ের কাজ করেছি। ভুল-ত্রুটি হয়েছে, স্বীকার করছি। ইসলামপুরের অনেক মিল বাদ পড়েছে, আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো।

এদিকে সরকারের ঘোষণার পর থেকেই বাজারে লবণ বিক্রি কমে গেছে বলে অভিযোগ লবণ ব্যবসায়ীদের। অনেক মিল মালিক বিপুল পরিমাণ লবণ মজুত রেখেছেন, যা এখন বিক্রি না হওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হলো- বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতির পরিবারের পাঁচটি মিল পেয়েছে ৬৪০ মেট্রিক টন লবণ সরবরাহের দায়িত্ব। অন্যদিকে বহু প্রতিষ্ঠানে কোনো বরাদ্দই যায়নি।

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে পাঠানো হয়েছে দুর্গম এলাকায়, যেখানে পরিবহন খরচ বহন করে লবণ পাঠানো প্রায় অসম্ভব। এই কারণে অনেকে বরাদ্দ ফিরিয়ে দিতেও বাধ্য হচ্ছেন।

আবার শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মাঠ প্রশাসনের চাহিদা কম থাকায় শেষ মুহূর্তে সরবরাহ কমিয়ে আনা হয়েছে।

কিন্তু লবণ মিল মালিকরা বলছেন, সরকারের ঘোষণা বাজারে প্রভাব ফেললেও বরাদ্দ না পাওয়ায় বিপুল পরিমাণ লবণ গুদামে পড়ে আছে। ফলে ঈদের সময় সত্যিকারের চাহিদা মেটাতে সংকট তৈরি হতে পারে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, এটি এখনই জানলাম, এর আগে কেউ কিছু বলেনি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখবো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এফএ/জেআইএম