সবুজে ঢাকা মাঠ, সোনালি ধানের ক্ষেত কিংবা গ্রামের ছায়াঘেরা ঝোপঝাড়—বাংলার এমন কোনো কোণা নেই, যেখানে এক সাহসী পাখির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। সে পাখির গায়ে নেই রঙের বাহার, নেই ময়ূরের মতো পেখম কিংবা টিয়া পাখির মতো মধুর কণ্ঠস্বর। কিন্তু একটি মাত্র তীক্ষ্ণ ডাকে সে থমকে দিতে পারে হিংস্র শিকারি পাখিকেও। সেই পাখির নাম ফিঙে। ক্ষুদ্রদেহী হলেও তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর কর্মদক্ষতা এমন যে, প্রকৃতির বিশাল পরিসরে তার এক অনন্য স্থান গড়ে উঠেছে।
Advertisement
ফিঙে পাখিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ব্ল্যাক ড্রংগো’। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ডাইক্রুরাস ম্যাক্রোসারকাস’। ফিঙে সাধারণত কালচে কালো রঙের হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ফিঙের গায়ে নীলচে আভা বা বাদামি রঙের ছোঁয়াও দেখা যায়। তার লম্বা কাঁটাভরা লেজ, তীক্ষ্ণ চোখ আর সোজা ভঙ্গি সহজেই তাকে আলাদা করে শনাক্ত করা যায়। পাখিটির সবচেয়ে বড় পরিচয় সে ভীতু প্রকৃতির নয়। বরং ফিঙে প্রকৃতির বুকে এক সাহসী প্রহরীর নাম। যে নিজের চেয়ে বড় ও হিংস্র শিকারি পাখিকেও তাড়িয়ে দিতে পারে নির্ভয়ে। অনেক সময় দেখা যায়, শকুন, বাজ, চিল কিংবা দাঁড়কাকের মতো পাখির পেছনে তাড়া করছে এক ছোট্ট ফিঙে। যেন মাঠ-ঘাট পাহারা দেওয়া তার দায়িত্বের অংশ!
বাংলাদেশের পাখি পর্যবেক্ষকদের মতে, ফিঙে অন্যতম সেই দেশি পাখিদের মধ্যে একটি, যারা সাহসিকতার সাথে শিকারি পাখির মোকাবিলা করে এবং অন্য পাখিদের নিরাপত্তা দিতে চেষ্টা করে। তাই গ্রামবাংলার কৃষক কিংবা প্রকৃতিপ্রেমীরা ফিঙেকে একটি সাহসী ও উপকারী পাখি হিসেবেই চেনেন।
কৃষিক্ষেত্রেও ফিঙের অবদান কোন অংশে কম নয়। পোকামাকড় খেয়ে ফিঙে যেমন নিজের ক্ষুধা মেটায়; তেমনই রক্ষা করে ফসলের মাঠ, সবজির বাগান এবং গাছপালাকে। ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ যেমন পাতা ঝাপসা পোকা, ঘাসফড়িং কিংবা গাছের শত্রু লালপোকা এসবই ফিঙের প্রিয় খাদ্যতালিকার অংশ। ফলে কৃষকেরা পাখিটিকে তাদের বিপদের বন্ধু বলে মনে করেন। বিষমুক্ত চাষাবাদে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় ছোট পাখিটির গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।
Advertisement
তবে শুধু সাহস নয়, ফিঙে বুদ্ধিতেও কম যায় না। প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে, ফিঙে অন্য পাখির ডাক নকল করতে সক্ষম এবং তা করে অনেক সময় শিকার টানার কৌশল হিসেবেও। কোনো পোকা বা পতঙ্গকে আকৃষ্ট করতে সে ডাকে অন্য পাখির মতো করে, আর ঠিক সেই সুযোগে শিকার করে নেয়। এই চাতুর্যময় অনুকরণকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ক্লেভার মিমিক্রি’। একটি সাধারণ পাখির এমন প্রতারণামূলক বুদ্ধির ব্যবহার সত্যিই বিস্ময়কর।
আরও পড়ুন পরিবেশ ও জীবনে পর্বতের গুরুত্ব অপরিসীম পরিযায়ী পাখিতে মুগ্ধ লক্ষ্মীপুরবছরের যে কোনো সময়েই ফিঙে দেখা যায়। তবে বসন্তকাল ফিঙের প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে পুরুষ ফিঙে ঘনঘন ডাকে, নাচে এবং ঝোপে মজবুত বাসা তৈরি করে স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করে। নারিকেল গাছ, কাঁঠাল গাছ কিংবা বাঁশঝাড়ে এদের বাসা তৈরি হয়। ছোট হলেও এই বাসা যথেষ্ট সুরক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন। স্ত্রী ফিঙে সাধারণত ২-৪টি ডিম পাড়ে এবং দুজনেই ডিমে তা দেয় ও ছানাকে লালন-পালন করে।
তবে আজ নগরায়ন, আকাশচুম্বী মোবাইল টাওয়ার, বৃক্ষনিধন, কৃষিক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার এবং বসতির বিস্তারের কারণে ফিঙেসহ অনেক দেশি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাদের ডাক, তাদের ডানা মেলা, এমনকি তাদের সাহসিকতার গল্পও যেন কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় ফিঙেকে রক্ষা করা মানেই প্রকৃতিকে রক্ষা করা। ফিঙে শুধু একটি পাখি নয়; সে সাহসের প্রতীক, সংকটে আত্মরক্ষার কৌশলের প্রতিচ্ছবি। ফিঙে প্রকৃতির এক ক্ষুদ্র বলিষ্ঠ যোদ্ধা। শহরের জিয়া উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা মফস্বলের স্কুল মাঠে, গ্রামের পেছনের খোলা মাঠে কিংবা নদীর পাড়ে কেউ কেউ আজও ফিঙের সেই তীক্ষ্ণ ‘চ্যাঁচ’ ডাক শুনে চমকে ওঠে। মনে হয়, সেই ছোট পাখিটি যেন আমাদের মনের হারিয়ে যাওয়া সাহসকে আবার জাগিয়ে দিচ্ছে।
Advertisement
প্রকৃতি আমাদের অনেক কিছু শেখায়। আর ফিঙে যেন সেই শিক্ষারই এক প্রাণবন্ত প্রতিচ্ছবি। সাহস, বুদ্ধি আর নিঃস্বার্থ উপকারের নিঃশব্দ এক প্রতীক হয়ে জেগে আছে বাংলার আকাশে, মাঠে আর আমাদের মনে।
এসইউ/জিকেএস