খেলাধুলা

‘শুধু প্রবাসীদের ওপর নির্ভর করলে বাংলাদেশের ফুটবল চলবে না’

‘শুধু প্রবাসীদের ওপর নির্ভর করলে বাংলাদেশের ফুটবল চলবে না’

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইংল্যান্ডের হামজা চৌধুরী, কানাডার শামিত সোম কিংবা ইতালির ফাহামিদুল ইসলামের আগমনেই দেশের ফুটবলে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। অনেকদিন পর ফুটবল ঘিরে যে উন্মাদনা দেখা গেছে, তাতে দেশের সবচয়ে জনপ্রিয় এই খেলাটি নিয়ে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। গত মার্চ থেকে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের খবরের শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে ফুটবল।

Advertisement

সবারই ধারণা, জাতীয় দল হচ্ছে একটা দেশের ফুটবলের মানদণ্ড। জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ভালো হলে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা তৈরি হয়। ঠিক এ কারণেই বাফুফে তাৎক্ষণিক ভালো ফলাফল পেতে জাতীয় দলের পেছনে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ সামনে রেখে বাফুফে জাতীয় দলকে বিদেশে অনুশীলন করায়, পাঁচতারকা হোটেল ক্যাম্প করে এবং নতুন সংযোজন হয়েছে উন্নতমানের প্রবাসী ফুটবলারের দলে অন্তর্ভুক্তি।

২০১৩ সালে ডেনমার্ক প্রবাসী জামাল ভূঁইয়াকে দিয়ে প্রবাসীর আগমন শুরু। সর্বশেষ ইংল্যান্ড প্রবাসী হামজা চৌধুরী, ইতালি প্রবাসী ফাহামিদুল ইসলাম ও কানাডা প্রবাসী শামিত সোম যুক্ত হলেন।

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও তারকা ফুটবলার ফিরোজ মাহমুদ টিটু প্রবাসীদের দলে নিয়ে তাৎক্ষণিক জয় পাওয়ার চেষ্টাকে ইতিবাচক মনে করলেও তিনি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন নিজেদের খেলোয়াড় তৈরির ওপর।

Advertisement

‘উন্নতমানের প্রবাসী এনে তাৎক্ষণিক ফলাফল পাওয়ার যে চেষ্টা সেটা ইতিবাচক। এর মাধ্যমে ফুটবলে একটা জাগরণ তৈরি হয়েছে। সময়ের চাহিদার জন্য এটা ভালো। ভালো মানের আরও প্রবাসীও আনা যেতে পারে। ওদের ব্যাসিক আমাদের ফুটবলারদের চেয়ে ভালো। তবে এই যে জৌলুস তৈরি হয়েছে সেটাকে ধরে রাখতে আমাদেরও বেশি বেশি ফুটবলার তৈরি করতে হবে।’

‘এই যে হামজা-শামিতরা এসেছেন। তারা তো নাও আসতে পারতেন। আগামীতে তারা বা তাদের মতো কেউ নাও আসতে পারেন। তখন কি হবে? যে কারণে কেবল প্রবাসী ফুটবলারদের ওপর নির্ভর করে থাকা ঠিক হবে না। তাতে বাংলাদেশের ফুটবল চলবে না। এখন কিছু ভালো প্রবাসী খেলালাম, ভালো কিছু রেজাল্ট হলো। ভবিষ্যতে কি হবে? সেটা মাথায় রাখতে হবে। শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে'- বলেন ফিরোজ মাহমদু টিটু।

সাবেক এই তারকা ফুটবলার হামজা, শামিত ও ফাহামিদুলদের দেশপ্রেমের প্রশংসা করে বলেন, ‘ওদের দেশপ্রেম আছে বলেই নিজ দেশের জার্সি পরেছেন। তারাই ফুটবলে হাইপ তুলে দিয়েছেন। ধরেন, কোনো কারণে হামজা খেলতে পারলেন না। ইনজুরির কারণে হোক কিংবা ক্লাবের শিডিউল ব্যস্থতার কারণে, তাদের না পেলে তখন কি হবে? আমাদের হাতে তো দুজন-তিনজন হামজা নেই। তাই তাদের কাছ থেকে আমাদের যেমন সেবা নিতে হবে, তেমনি নিজেদেরও খেলোয়াড় তৈরি করতে হবে। তাই অপশন বাড়াতে হবে। এজন্যই আমার পরিষ্কার কথা, কেবল তাৎক্ষণিক রেজাল্ট পাওয়ার দিকেই নয়, নজর দিতে হবে খেলোয়াড় তৈরিতেও।’

কীভাবে খেলোয়াড় বাড়ানো যায় তার একটা পথও বাতলে দিয়েছেন সাফজয়ী সাবেক এই তারকা ডিফেন্ডার। দেশের ৬৪ জেলায় যে স্টেডিয়াম আছে সেখানে সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একাডেমি তৈরি করতে হবে। জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে এটা হতে পারে। সাত বছর বয়সের ৩০ জন বাচ্চা নিয়ে একাডেমি করতে পারলে দুই শতাধিক খেলোয়াড়কে ট্রেনিং করানো যাবে। সাত বছর পর্যন্ত রেখে পরিচর্যা করলে অনেক খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। প্রত্যেক জেলায় ভালো মানের একজন কোচকে দায়িত্ব দিতে হবে। কোচদের গাইড করার জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকতে পারে। বাফুফে থেকে এই উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিতে হবে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সহায়তা করতে পারে।’

Advertisement

‘তাদের অবকাঠামোতে যে ব্যয় সেটা কমিয়ে ট্রেনিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে। জেলায় যে বিত্তশালীরা আছেন তাদের কাছ থেকেও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এভাবে একাডেমি চালাতে পারলে জেলার একটা দলও হয়ে যাবে। এ উদ্যোগ উপেজলা পর্যায়ে নিতে পারলে তো আরও ভালো। তবে জেলা থেকে শুরু করা যেতে পারে। এভাবে খেলোয়াড় তৈরি করতে পারলে ১০ থেকে ১৫ বছরে ফুটবলের চেহারা বদলে যাবে।’

আমাদের তো বিকেএসপির মতো একটা প্রতিষ্ঠান আছে। ফুটবলের জন্য কতটা কাজে আসছে এই প্রতিষ্ঠান? ‘দেখুন আমি বিকেএসপি থেকে উঠে এসেছি। এই প্রতিষ্ঠানে ফুটবলের যারা কোচ আছেন তাদের বায়োডাটা দেখেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, তারা কোন লেভেলে ফুটবল খেলেছেন। এখানে ভালো মানের কোচ দিতে হবে। বিকেএসপিতে কোচ নিয়োগে স্বচ্ছতা আছে কি না আমার সন্দেহ আছে। এখানে একটা সিস্টেম আছে, সেভাবেই চলছে আর কি। সেভাবে খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না। ফুটবলারদের ইচ্ছা আছে ভালো খেলার। তবে তাদের গাইড করার দরকার আছে'- বলেন টিটু।

নতুন খেলোয়াড় উঠে এসে তারা খেলবেন কোথায়? তরুণদের আকর্ষণ করার মতো কি আমাদের শীর্ষ লিগ মানসম্মত? ফিরোজ মাহমুদ টিটু বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ তরুণদের আকৃষ্ঠ করার মতো। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে এখন বেতন অনেক। এই তরুণদের জন্য কিন্তু এমন বেতনের চাকরির অভাব। তাই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ খেলার জন্য তরুণদের আগ্রহ বাড়াতে পারে।’

‘দেখুন, জেলায় জেলায় খেলোয়াড় তৈরি হলে সেখানে কিন্তু প্রতিযোগিতা হবে, লিগ হবে। জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এক সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খেলোয়াড় তৈরি হতে থাকবে। আসল কথা হলো একটা পলিসি দাঁড় করাতে হবে। তখন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বলেন কিংবা জাতীয় দল- সেখানে খেলোয়াড় সরবরাহ বাড়বে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হবে। আজ ম্যারাডোনাকে আনলাম, আরেকদিন আরেকজনকে, এটা কোনো পলিসি নয়। সাময়িক হাইপ। আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত খেলোয়াড় তৈরি করা।’

এখন যারা জাতীয় দলে খেলেন তারা অনেক ভালো ট্রেনিংয়ের সুযোগ পান উল্লেখ করে সাবেক এই তারকা ডিফেন্ডার বলেন, ‘আমি বাফুফের সাবেক সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন ভাইকে এজন্য কৃতিত্ব দেবো যে, তিনি ফুটবলারদের আর্থিত বিষয়টি চিন্তা করে লিগটা নিয়মিত আয়োজন করেছেন, জাতীয় দলের জন্য ম্যাচ বাড়িয়েছেন। আমরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রায় ১৮ মাস কোনো খেলাই পাইনি। আমরা তো প্রপার ট্রেনিং পেতাম না। অনেক সময় ট্রেনিং ছাড়াই খেলতে হয়েছে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা এখন উন্নত প্রশিক্ষণ পান। তবে সালাউদ্দিন ভাইয়ের আরও তৃণমূলে যাওয়া উচিত ছিল। একাডেমিতে আরও জোর দেওয়া উচিত ছিল। সেখানে একটা ঘাটতি ছিল।’

জাতীয় দলের সর্বশেষ তিনটি ম্যাচ প্রসঙ্গে টিটু বলেন, ‘আমি সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচটি স্টেডিয়ামে বসে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। দেখা গেছে আক্রমণভাগে খেলোয়াড় নেই, তারপরও ক্রস ফেলছেন। এটা কন্ট্রোল করে খেলা যেতো। হামজা ও শামিত সোম থাকায় আমাদের মধ্য মাঠ শক্তিশালী ছিল। যে কারণে মাঝ মাঠে বল ধরে রেখে খেলার চেষ্টা করেছে। সেটা ইতিবাচক ছিল। আমাদের দুই উইংব্যাক আপ টু দ্য মার্ক ছিল না। নাম্বার নাইনে খেলোয়াড় দরকার ছিল। উইংয়ে ফাহামিদুল ভালো করেছেন। ওকে আরও গাইড করা দরকার আছে। আসলে হামজা ও শামিতের লেভেল উঁচুমানের। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে খেলতে আমাদের খেলোয়াড়দের সময় লাগবে। যে কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা গেছে।’

আরআই/আইএইচএস/