২০২৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ১০ শতাংশ বেড়ে ২২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা এ অঞ্চলের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন খাতে সম্প্রসারণ ও ভোক্তা বাজারের উন্নতির ফলে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।
Advertisement
১৯ জুন (বৃহস্পতিবার) জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৫’ এ জানানো হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ ইতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও বৈশ্বিক চিত্র মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্বব্যাপী এফডিআই ২০২৪ সালে ১১ শতাংশ কমে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো পতনের মুখে পড়েছে, যা উৎপাদনমুখী মূলধন প্রবাহে গভীর মন্থরতা নির্দেশ করে।
বিগত বছরের তুলনায় সামান্য ৩ শতাংশ কম বিনিয়োগ পেলেও এশিয়া সামগ্রিকভাবে বিশ্বের সর্বোচ্চ এফডিআই প্রাপ্ত অঞ্চল হিসেবে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চ সুদের হার, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দুর্বল পুনরুদ্ধারের প্রভাবে বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্পে এগিয়ে আসতে অনীহা দেখাচ্ছে। ফলে বৈশ্বিকভাবে উৎপাদন ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ কমছে।
Advertisement
২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ৪ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও এ বৃদ্ধির মূল কারণ ছিল কয়েকটি ইউরোপীয় অর্থনীতির মাধ্যমে অস্থির আর্থিক প্রবাহ—যেগুলো প্রায়ই বিনিয়োগ স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আঙ্কটাডের এ রিপোর্ট আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় চতুর্থ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন সম্মেলনের প্রাক্কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও বাস্তব বিনিয়োগ প্রবাহের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান নিয়ে আলোচনা করবেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে ইউরোপ বিনিয়োগে বড় ধস দেখেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ প্রবাহ মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আরও গভীর সংকট। অনেক দেশেই মূলধন স্থবির হয়ে পড়ছে কিংবা পুরোপুরি উপেক্ষিত হচ্ছে অবকাঠামো, জ্বালানি, প্রযুক্তি ও শিল্পখাত—যেগুলো কর্মসংস্থান তৈরির মূল চালিকাশক্তি।
জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান বলেন, অনেক অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ছে শুধু সম্ভাবনার অভাবে নয়, বরং বর্তমান ব্যবস্থা বিনিয়োগ করে সেখানে তা সহজ। তবে আমরা এই বাস্তবতা বদলাতে পারি। যদি সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগকে উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে পারি। আজকের অস্থিরতাই হতে পারে আগামীর সম্ভাবনা।
Advertisement
আরও পড়ুন
২০২৫ সালে দ. এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫.৬ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস বাণিজ্য বৈষম্যের ঝুঁকিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতি মার্কিন শুল্ক-ভারতের নিষেধাজ্ঞায় চাপে পড়বে দেশের রপ্তানি খাতপ্রতিবেদনের মাধ্যমে আঙ্কটাড জোর দিয়ে বলেছে, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বৈশ্বিক বিনিয়োগ ও অর্থায়ন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
অঞ্চলভেদে বিনিয়োগ চিত্রআফ্রিকাএই মহাদেশে এফডিআই ৭৫ শতাংশ বেড়েছে, যার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে মিশরের একটি বড় বিনিয়োগ প্রকল্প। তবে প্রকল্পটি বাদ দিলেও আফ্রিকায় বিনিয়োগ ১২ শতাংশ বেড়েছে, যা বিনিয়োগ সহায়তা ও নিয়ন্ত্রক সংস্কারের ফলে সম্ভব হয়েছে।
এশিয়া৩ শতাংশ হ্রাস সত্ত্বেও এশিয়া বিশ্বে সর্বোচ্চ এফডিআই গ্রহণকারী অঞ্চল হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ২২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে, যা রেকর্ড অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলএই অঞ্চলে মোট এফডিআই প্রবাহ ১২ শতাংশ কমে গেছে। তবে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং মেক্সিকোর মতো প্রধান বাজারে নতুন গ্রিনফিল্ড প্রকল্পের ঘোষণা বেড়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত।
মধ্যপ্রাচ্যএ অঞ্চলে বিনিয়োগ প্রবাহ শক্তিশালী রয়েছে, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণের ফলে এফডিআই বেড়েছে।
গঠনগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতিসবচেয়ে পিছিয়ে থাকা স্বল্পোন্নত দেশসমূহ এফডিআই প্রবাহ ৯ শতাংশ এবং ছোট দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে ১৪ শতাংশ বেড়েছে। তবে ভূমিবদ্ধ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ ১০ শতাংশ কমেছে। তিনটি ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ মাত্র কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে, যা বৈচিত্র্যহীনতার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।
বিশ্লেষকদের মতে, আঞ্চলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগের কেন্দ্রীকরণ ও কিছু নির্দিষ্ট দেশের ওপর নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই অঞ্চলভিত্তিক ভারসাম্যপূর্ণ বিনিয়োগ পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।
আঙ্কটাড প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৫’ এ জানানো হয়েছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বৈশ্বিক বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক প্রকল্প অর্থায়ন—যা সাধারণত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা ২৬ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি (-৩১%), পরিবহন (-৩২%) পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন (-৩০%) খাতে বিনিয়োগে বড় ধরনের পতন লক্ষ্য করা গেছে।
ডিজিটাল খাতে প্রবৃদ্ধি হলেও অসম বণ্টনএকই সময়ে ডিজিটাল অর্থনীতিতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ১৪ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধি মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উৎপাদন, ডিজিটাল সেবা ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে কেন্দ্রীভূত ছিল। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশ সব নতুন ডিজিটাল প্রকল্পের ৮০ শতাংশ আকর্ষণ করেছে। ফলে অনেক উন্নয়নশীল দেশ এখনো ডিজিটাল বিপ্লব থেকে পিছিয়ে পড়ছে, কারণ সেখানে অবকাঠামো, নীতিমালা ও দক্ষতার ঘাটতি প্রকট।
টেকসই উন্নয়নের অর্থায়নে ঘাটতিপ্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, বর্তমান বিনিয়োগের মাত্রা বৈশ্বিক উন্নয়নের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। শুধু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বছরে আনুমানিক চার ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন—যা অর্জন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
‘স্মার্ট’ পুঁজি ও সমন্বিত সংস্কারের আহ্বানআঙ্কটাড বলছে, বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কেবল অধিক পুঁজি নয়, প্রয়োজন ‘স্মার্ট’ বা বুদ্ধিদীপ্ত পুঁজি—যা দীর্ঘমেয়াদি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে ডিজিটাল খাতে এই মুহূর্তে অবকাঠামো, দক্ষতা ও নীতিমালার ব্যবধান অনেক দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে।ডিজিটাল শিল্পে রূপান্তরমূলক বিনিয়োগ টানতে সাত দফা প্রস্তাব
প্রতিবেদনটিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ডিজিটাল শিল্পে রূপান্তরমূলক এফডিআই টানতে সাহসী সংস্কার ও বৈশ্বিক সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে সাতটি অগ্রাধিকারমূলক ক্ষেত্রে একটি বহুপাক্ষিক কর্মসূচি প্রস্তাব করা হয়েছে।
আঙ্কটাডের প্রস্তাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টেকসই ডিজিটাল শিল্প গড়ে তোলার জন্য সাতটি অগ্রাধিকার খাতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রথমত, ডেটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন করতে হবে, যাতে টেকসই ডিজিটাল উন্নয়ন কৌশল গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজন অনুযায়ী ডিজিটাল বিনিয়োগ নীতিমালার উপযোগী টুলকিট তৈরি করতে হবে।
তৃতীয়ত, বহুপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে ডিজিটাল বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নিয়মনীতি গড়ে তুলতে হবে।
চতুর্থত, গ্লোবাল পার্টনারশিপ ও সম্মিলিত অর্থায়নের মাধ্যমে ডিজিটাল অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে।
পঞ্চমত, উদ্ভাবনমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পখাতের মধ্যে অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে।
ষষ্ঠত, লক্ষ্যভিত্তিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা সহায়তার মাধ্যমে ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াতে হবে।
এবং সপ্তমত, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় রেখে দায়িত্বশীল ও টেকসই ডিজিটাল বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে হবে।
আইএইচও/এএসএ/ইএ