জাতীয়

হাসি-ঠাট্টার কল ৮৩ হাজার, নম্বর ব্লক করতে বাধ্য হচ্ছেন অপারেটর

হাসি-ঠাট্টার কল ৮৩ হাজার, নম্বর ব্লক করতে বাধ্য হচ্ছেন অপারেটর

ইব্রাহিম শেখ নামে একজন ঈদের রাতে ৯৯৯-এ ফোন করে হাসি-ঠাট্টা করতে থাকেন। প্রথমে কল দিয়ে প্রায় দেড় মিনিট হাসি-ঠাট্টা করেন। দ্বিতীয়বার কল দিয়েও একই কাজ করেন তিনি। পরে ৯৯৯ থেকে তার নম্বরটি ব্লক করে দিতে বাধ্য হন অপারেটর।

Advertisement

ঈদের পরদিন কয়েকজন শিশু তাদের মা-বাবার মোবাইল থেকে অনবরত ৯৯৯-এ ফোন করতে থাকে। ৩০ মিনিট ধরে ছয়টি অপারেটরের নম্বর থেকে ৯৯৯-এ কল করে শিশুরা। তারা গল্প শুনতে চায়, ৯৯৯ কীভাবে কাজ করে তা জানতে চায় আবার অনেক শিশু জানতে চায় ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়বে কি না।

ঈদের ছুটিতে মারামারি সংক্রান্ত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ সেবা নিয়েছে। টাকা-পয়সার লেনদেন, স্বামী-স্ত্রীকে জোর করে আটকে রাখার বিষয়ে প্রতিকার চেয়েও অনেক ফোন এসেছে। সব মিলিয়ে কয়েক লাখ কল এলেও না বুঝে অপ্রয়োজনীয় কলই বেশি, যা জরুরি সেবার মধ্যে পড়ে না।- জাতীয় জরুরি সেবার পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার

ইব্রাহিম ও শিশুদের মতো ঈদের ছুটির প্রথম সাতদিনে ৯৯৯-এ এমন অপ্রয়োজনীয় কল এসেছিল ৮২ হাজার ৮৬৫টি। ৯৯৯ জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ সহায়তা চেয়ে ফোন দেয়। কিন্তু একদল মানুষ অবিবেচনাপ্রসূত অপ্রয়োজনীয় কল করে নম্বর ব্যস্ত রাখেন। এতে অনেকে প্রয়োজনীয় সেবা থেকেও বঞ্চিত হন।

Advertisement

৯৯৯ কর্তৃপক্ষ বলছে, জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে এভাবে অপ্রয়োজনীয় কল করলে জরুরি সেবা প্রদান বিঘ্নিত হয়। অনেক সময় জরুরি সেবা গ্রহণকারী ব্যক্তিকে অপেক্ষা করতে হতে পারে। যদিও প্রতি মুহূর্তে ৯৯৯-এ ১০০টি কল রিসিভ করার সক্ষমতা রয়েছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সংক্রান্ত সেবা দেওয়ার পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী অন্য জরুরি সেবাও দিচ্ছে ৯৯৯।

অপ্রয়োজনীয় ফোনকল ওয়েটিং টাইম বাড়িয়ে দ্রুত সেবা নিতে বাধার সৃষ্টি করছে, যা বিপদে পড়া কলারকে সেবা পেতে দেরি করাচ্ছে ও ৯৯৯-এর সেবাদানকারীদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।- ৯৯৯–এর পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউল ইসলাম

ঈদের ছুটিতে সেবা

ঈদুল আজহার ছুটিতে সারাদেশে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ১৫ হাজার ৬১৯ জন ব্যক্তি সেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চার হাজার ১০২ জন সেবা নিয়েছেন মারামারি-সংক্রান্ত বিষয়ে। গত ৫ থেকে ১৩ জুন ঈদুল আজহার ছুটিতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে দুই লাখ ২০ হাজার ৩৮৮টি কল আসে। এসব কলের মধ্যে ১৫ হাজার ৬১৯ জন জরুরি সেবা পেয়েছেন; যাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৩১ জন জরুরি পুলিশি সেবা, ৯৯৩ জন অ্যাম্বুলেন্স সেবা এবং ৭৯৫ জন জরুরি ফায়ার সার্ভিস সেবা পেয়েছেন।

আরও পড়ুন ৯৯৯-এ ফোনকল, ৩ কাঠবিড়ালি শাবক উদ্ধার করে বনবিভাগে হস্তান্তর  ঈদের ছুটিতে ৯৯৯-এ ভুয়া কলই ছিল লাখের বেশি  পুলিশও যদি হয়রানি করে ৯৯৯-এ কল দিন, ব্যবস্থা নেব : আইজিপি 

যেসব ব্যক্তি জরুরি সেবা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চার হাজার ১০২ জন সেবা নিয়েছেন আধিপত্য বিস্তার ও তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মারামারি সংক্রান্ত বিষয়ে। এছাড়া এক হাজার ২১৪ জনকে লেনদেন নিয়ে জোর করে আটকে রাখা, এক হাজার ৬২ জনকে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি মেডিকেল সেবা এবং ৯৯২ জনকে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেবা দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

এছাড়া এক হাজার ২৭১ জনকে ঈদুল আজহায় গরুর হাটে চাঁদাবাজি, রাস্তায় চাঁদাবাজি, নদীতে চাঁদাবাজি, জোরপূর্বক পশু অন্য হাটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ, অজ্ঞান-মলম পার্টি এবং শব্দদূষণ-সংক্রান্ত বিষয়ে সেবা দেওয়া হয়েছে।

যত অপ্রয়োজনীয় কল

৯৯৯-এ মানুষ সেবা নেওয়ার জন্যই ফোন করে। তবে একদল দুষ্টু লোক এখনো ৯৯৯-এ মিসড কল কিংবা হাসি-তামাশার জন্য কল করেন। এর সংখ্যাও কম নয়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে পুলিশ। এবার ঈদে এমন কলের সংখ্যা ছিল অনেক। এবার ঈদের ছুটির সাত দিনে এমন ফোনকলের সংখ্যা ৮২ হাজার ৮৬৫টি।

৯৯৯-এ সাত দিনে ব্লাংক কল করা হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৯টি, প্রাংঙ্ক কল করা হয়েছে ৪ হাজার ৩০০টি এবং মিসড কল এসেছে ৭ হাজার ৬৫৬টি।

৯৯৯ এর কাছে প্রতিটি কলই গুরুত্বপূর্ণ

৯৯৯ এর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি কলই গুরুত্বপূর্ণ সেটা ফলস কলই হোক আর প্রাংঙ্ক কল হোক। যদিও এসব কল প্রকৃত জরুরি সেবা প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে। ভুয়া কলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং নম্বরটি ব্লক করে দেওয়া হবে। অসতর্কতার কারণে যাতে ৯৯৯-এ কল না যায় সেজন্য আপনার মোবাইলটি লক করে রাখুন।

সচেতনতায়ও ফোন দিয়েছে শিশুরা

ঈদের ছুটিতে অনেক শিশুই ৯৯৯-এ ফোন করে সেবা নিয়েছে। তাদের মধ্যে উচ্চস্বরে সাউন্ড বক্স বাজানো, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখে ফোন ও মারামারি দেখেও অনেক শিশু ৯৯৯-এ ফোন করে সেবা নিয়েছে।

৯৯৯-এর কর্মকর্তারা বলছেন, ৯৯৯ জরুরি সেবা নম্বরে বিনা কারণে প্রতিদিন প্রচুর শিশু ফোন করে। ফলে প্রকৃত বিপদগ্রস্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। সময় ও সুযোগ করে আপনার সন্তানদের শেখান কীভাবে এবং কখন ৯৯৯-এ ফোন করতে হবে। কখন ফোন করবে না সেটিও শেখান।

বাড়ছে নারীদের ফোনকলের সংখ্যা

ঈদের ছুটিতে পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুক, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অভিযোগে নারীরা ৯৯৯-এ ফোন করে সেবা নিয়েছেন। তবে শিশুদের চেয়ে নারী কলারদের ফোনকলের সংখ্যা কম। ৪ জুন ৯৯৯-এ ফোন করে সেবা নিয়েছেন ১২৯ জন নারী, ৫ জুন ১২৬, ৬ জুন ১১৮, ঈদের দিন ৭ জুন ১১৬, ৮ জুন ১০১, ৯ জুন ১৬৬ ও ১০ জুন ১৪৯ জন নারী।

পুলিশ সদস্যরাও সেবা নিয়েছে ৯৯৯-এ ফোন করে

ঈদের ছুটিতে পুলিশ সদস্যরাও ফোন করে সেবা নিয়েছে। ৪ জুন ৯৯৯ এ ফোন করে সেবা নিয়েছেন ২২ জন, ৫ জুন ৩৮ জন, ৬ জুন ৩৯ জন, ৭ জুন ২৭ জন, ৮ জুন ২০ জন, ৯ জুন ২১ জন এবং ১০ জুন সেবা নিয়েছেন ২২ জন পুলিশ সদস্য। তবে পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশ ফোন ছিল পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বরতদের ফোন নম্বর চেয়ে।

যা বলছেন ৯৯৯-এর কর্মকর্তারা

জাতীয় জরুরি সেবার পরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা) আনোয়ার সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকলেও জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কোনো ছুটি থাকে না। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এবার বিভিন্ন সহায়তার জন্য ফোনকল আসে দুই লাখ ২০ হাজার ৩৮৮টি। এসব কলের মধ্যে ১৫ হাজার ৬১৯ জন জরুরি সেবা পেয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে মারামারি সংক্রান্ত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ সেবা নিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, তুচ্ছ কারণে এসব মারামারির ঘটনা ঘটেছে। টাকা-পয়সার লেনদেন, স্বামী-স্ত্রীকে জোর করে আটকে রাখার বিষয়ে প্রতিকার চেয়েও অনেক ফোন এসেছে। সব মিলিয়ে কয়েক লাখ কল এলেও না বুঝে অপ্রয়োজনীয় কলই বেশি, যা জরুরি সেবার মধ্যে পড়ে না।’

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘৯৯৯ জরুরি মুহূর্তে পুলিশ, ফায়ার ও অ্যাম্বুলেন্স সেবাসহ বিভিন্ন তথ্যসেবার জন্য নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ৯৯৯-এ বেশিরভাগ কলই অপ্রয়োজনীয়। অপ্রয়োজনীয় ফোনকল ওয়েটিং টাইম বাড়িয়ে দ্রুত সেবা নিতে বাধার সৃষ্টি করছে, যা বিপদে পড়া কলারকে সেবা পেতে দেরি করাচ্ছে ও ৯৯৯-এর সেবাদানকারীদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বিরক্তিকর কল করলে লাখ টাকা জরিমানা

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ এর ৭০(১) ধারায় বিরক্তিকর কলের জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান থাকলেও ৯৯৯ এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে এ আইনে অভিযোগ আনা হয়নি।

টিটি/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস