নিজের মরণ ডেকে এনেছে ইসরায়েল

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত চলছে। উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন বলেছেন, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের ক্যানসার স্বরূপ। যুদ্ধ বিশারদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান মধ্যপ্রাচ্যের সিংহ। তারা ইরানে মরণ কামড় দিতে গিয়ে ইসরায়েল এখন বুঝতে পারছে, সিংহকে ঘুমন্ত থাকতে দেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ ছিল।

ইরান হাইপরসনিক মিসাইল ছুড়ে ইসরায়েলের ইয়াম বাথ, হাইফা ও তেলআবিবে যে ধ্বংসস্তূপ সৃষ্টি করে ফেলেছে সেটা নিয়ে ইসরায়েল আগেভাগে কোনো কল্পনাও করতে পারেনি। ইসরায়েল বার বার ভুল করে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়মিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কেউ কেউ একে ‘সাহসিকতা’ বলছে, কেউ বলছে ‘অত্যাশ্চর্য কূটনৈতিক ভুল’।  কেউ বলছে ‘প্রতিরক্ষা’ কেউ বলছে ‘প্ররোচনা’। কিন্তু বাস্তবতা একটাই—ইরানের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে, বিশেষ করে দামাস্কাসে ইরানি কনসুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হানার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল শুধু ইরানকে নয়, নিজেকেও একটি অপ্রতিরোধ্য অগ্নিমৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে। এবার  ইরানকে ‘মরণ কামড়’ দিতে গিয়ে ইসরায়েল যেন নিজের মুখেই আগুন ঢেলে দিয়েছে।

দুই দশক ধরে ইসরায়েল একের পর এক কৌশলী হামলায় ইরানপন্থি গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করে আসছে। গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ, সিরিয়ায় কুদস ফোর্স—এগুলোকে লক্ষ্য করে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু সেই অপারেশনগুলো কখনোই ইরানের মূল ভূখণ্ড কিংবা কূটনৈতিক ভবনকে এতটা সরাসরি আঘাত করেনি। দামাস্কাসে ইরানি কনসুলেট ভবনে হামলা সেই সীমারেখা ভেঙেছে।

এই হামলা ইরানের জন্য ছিল এক অর্থে জাতীয় মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নীতির ন্যূনতম নিয়ম উপেক্ষা করে, এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের কনসুলেটে হামলা চালিয়েছে, যা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এর জবাব না দিলে ইরান তার জনগণের সামনে আত্মসমর্পণকারী বলেই বিবেচিত হতো। ফলে ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে এমন এক আগুনে হাত দিয়েছিল, যার জ্বলন কতদূর যেতে পারে, সেটা হয়তো ভাবেনি বা ভেবেও গুরুত্ব দেয়নি।

ইরানের পাল্টা হামলা, শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া এবং তাতে হাইফা, বাত ইয়ামসহ একাধিক শহরে ক্ষয়ক্ষতি প্রমাণ করেছে—ইরান শুধু বুলি দেয় না, এখন আঘাত করতেও সক্ষম। আয়রন ডোম দিয়ে সব প্রতিরোধ করা যায় না, এটা হাড়ে হাড়ে বুঝছে তেল আবিব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে— ইসরায়েল কী অর্জন করলো এই মরণ কামড়ে? একটি সামরিক ভবন ধ্বংস? কিছু কুদস কমান্ডার নিহত? তার বিনিময়ে গোটা জাতিকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো। দেশের ভেতরে আতঙ্ক, স্কুল-কলেজ বন্ধ, নাগরিকরা বাংকারে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অনিশ্চয়তায় এবং যুদ্ধজটে পড়ে কূটনৈতিকভাবে কোণঠাসা—এটাই কি ছিল সেই মহান ‘স্মার্ট স্ট্র্যাটেজি’?

উল্টো বরং ইরানের জনমত এবার প্রথমবারের মতো যুদ্ধ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ। এতদিন যারা সরকারবিরোধী ছিল, তারাও বলছে, ‘এ আঘাতের জবাব দিতেই হতো।’ আবার ইসরায়েলে অভ্যন্তরীণভাবে বাড়ছে সরকারের সমালোচনা—কেন এমন এক উসকানিমূলক কাজ করে গোটা জাতিকে যুদ্ধের মুখে ফেলে দেওয়া হলো? তেল আবিবে বসেই অনেক নাগরিক বুঝতে পারছেন, এবার আর গাজা বা লেবানন নয়, এক পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেশের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েল, যার কোনো পূর্বানুমানযোগ্য শেষ নেই।

যুদ্ধ কেউ চায় না, আর আগুন দিয়ে আগুন নিভে না—এ প্রাচীন বুদ্ধির কাছে আধুনিক ‘স্মার্ট যুদ্ধ’ পরাস্ত হয়েছে। ইরানে মরণ কামড় দিতে গিয়ে ইসরায়েল এখন বুঝতে পারছে, সিংহকে ঘুমন্ত থাকতে দেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ ছিল। ইতিহাসের পাঠ একটাই—যে অন্যকে নিঃশেষ করতে চায়, সে আগে নিজেকে নিঃশেষের পথে ঠেলে দেয়। ইসরায়েল এই কঠিন পাঠে নাম লিখিয়ে ফেলেছে— একটা কামড়ের দম্ভে, একটা আগুনের খেলায়।

তেল আবিবের এই ভুল যুদ্ধনৈতিক কৌশল বিশ্বের কাছে একটি বার্তা দিচ্ছে—অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ কিংবা সাময়িক প্রতিশোধের বশে নেওয়া সিদ্ধান্ত কখনো টেকসই নয়। ইসরায়েল হয়তো ভেবেছিল, ইরানকে চাপে ফেলবে, কিন্তু বাস্তবে সে জেগে তুলেছে এক ঘুমন্ত সিংহ, যার গর্জনে এখন গোটা অঞ্চলে কাঁপন।

যুদ্ধ শুরুর চারদিনের মাথায় হাইফা ও বাথ ইয়ামে ইরানের মিসাইলে আঘাতে আঁতকে ওঠে এখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জড়াতে চায় তেল আবিব। মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলে উঠলে, তার ছাই উড়ে যায় ওয়াশিংটন পর্যন্ত। আর এখন সেই আগুন জ্বালিয়ে রেখে আরও বড় আগুন চাইছে তেল আবিব—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যতই আঞ্চলিক দেখাক, বাস্তবতা হলো, এটি বহু আগেই আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। শুধু ভেতরে ভেতরে নয়, এখন তেল আবিব খোলাখুলিই চাইছে, হোয়াইট হাউজ শুধু সহানুভূতি নয়, সামরিক হস্তক্ষেপেও সরাসরি এগিয়ে আসুক।

গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তেল আবিবের একমাত্র লক্ষ্য এখন ইরানকে সামরিকভাবে দুর্বল করা—যে লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইসরায়েল একাই নামতে চাইছে না। বরং তারা স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পক্ষে মাঠে নামাতে চায়।

বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরেই ইসরায়েলের নিরাপত্তার ‘গ্যারান্টার’। বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য, যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি, আর জাতিসংঘে ইসরায়েলপন্থি অবস্থান—সবই ইসরায়েলের পক্ষে একটি অঘোষিত ‘সুরক্ষা ছাতা’ তৈরি করেছে। কিন্তু এবার ইসরায়েল সেই ছাতাটি শুধু মাথার ওপর রাখতে চাচ্ছে না—তারা চায়, ছাতার মালিকও অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামুক।

তেল আবিবের এই আগ্রহের পেছনে কয়েকটি কৌশলগত ব্যাখ্যা আছে— প্রথমত, ইরানের সামরিক সক্ষমতা আগের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী হয়েছে। সরাসরি হামলার জবাবে ইরান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানছে। ইসরায়েল একা ইরানের পরমাণু স্থাপনা ও সামরিক কাঠামোর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালাতে ভয় পাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকলে আঞ্চলিক আরব শক্তিগুলোও পাশ কাটানো সহজ হবে। তৃতীয়ত, এই যুদ্ধকে বৃহৎ পরিসরে টেনে এনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে  ‘ইরান-একটি হুমকি’ বার্তা প্রতিষ্ঠা করা তেল আবিবের পুরোনো কৌশল।

তবে বিষয়টি এখানেই থেমে নেই। হোয়াইট হাউজ এখন এক চরম দ্বিধার মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র জানে, সরাসরি ইরানবিরোধী যুদ্ধে নামা মানে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ, বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার বিস্ফোরণ। হুথি, হিজবুল্লাহ, পিএমইউ, এমনকি সিরিয়ার বাকি গোষ্ঠীগুলোও এতে জড়াবে। তাতে মার্কিন ঘাঁটি, সেনা, এমনকি ইউরোপীয় মিত্রদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া রাজনীতিও এই যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষে নয়। কিন্তু তেল আবিব কূটনৈতিকভাবে খুব চতুর। তারা জানে, সরাসরি সেনা পাঠানো না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রকে ঘটনার গতিতে জড়ানো সম্ভব। যেমন— যদি ইরান আবার সরাসরি ইসরায়েল আক্রমণ করে, তখন ‘আত্মরক্ষা’-র নামে যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রতিরক্ষামূলক’ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। অথবা যদি ইসরায়েল ইরানের পরমাণু স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা চালায় এবং ইরান পাল্টা আক্রমণে মার্কিন ঘাঁটিতে কিছু করে, তখন যুদ্ধ বাঁধবেই।

অর্থাৎ তেল আবিব যুদ্ধের দায় ইরানের ঘাড়ে চাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনার ছক আঁকছে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। ইসরায়েল যদি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে নামাতে পারে, তবে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা থাকবে না— তা হয়ে উঠবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক স্পষ্ট ইঙ্গিত। এর চূড়ান্ত খেসারত দেবে কে? ইরানি বা ইসরায়েলি জনগণ, আমেরিকার করদাতা এবং গোটা মুসলিম বিশ্ব—যাদের ওপর একের পর এক আগুন পড়বে, অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, আর মানুষের জীবন হবে অনিশ্চয়তার ক্রীড়ানক।

তেল আবিব জানে, একা লড়াই চালিয়ে ইরানকে থামানো সম্ভব নয়। তাই সে এখন তার পুরোনো অস্ত্র—ওয়াশিংটনের বন্ধুত্বকে যুদ্ধের হাতিয়ার বানাতে চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি এবারও চোখ বুজে সেই ফাঁদে পা দেবে? নাকি সময় এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের এই ‘চিরস্থায়ী দাহ' থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার সাহস দেখানোর? সিদ্ধান্ত এখন হোয়াইট হাউজের, কিন্তু মূল্য চুকাতে হবে বিশ্ববাসীকে।

এ যুদ্ধের ফলাফল কী হবে, তা কেউ জানে না। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত— ইসরায়েল যদি এই মুহূর্তে না থামে, না সরে আসে আগ্রাসনের নীতিমালা থেকে, তবে এই ‘মরণ কামড়’ একদিন তার নিজের জন্যই ‘মরণ’ হয়ে দাঁড়াবে। যার প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

যুদ্ধ কেউ চায় না, আর আগুন দিয়ে আগুন নিভে না—এ প্রাচীন বুদ্ধির কাছে আধুনিক ‘স্মার্ট যুদ্ধ’ পরাস্ত হয়েছে। ইরানে মরণ কামড় দিতে গিয়ে ইসরায়েল এখন বুঝতে পারছে, সিংহকে ঘুমন্ত থাকতে দেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ ছিল। ইতিহাসের পাঠ একটাই—যে অন্যকে নিঃশেষ করতে চায়, সে আগে নিজেকে নিঃশেষের পথে ঠেলে দেয়। ইসরায়েল এই কঠিন পাঠে নাম লিখিয়ে ফেলেছে— একটা কামড়ের দম্ভে, একটা আগুনের খেলায়।

লেখক:  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএফএ/জেআইএম