জাতীয় পার্টির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে এবং এ বিরোধের জের ধরে দলের একটি অংশ জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
Advertisement
দলটির নেতারা বলছেন, গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের দলীয় ক্ষমতা কমানোর উদ্যোগকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা অবস্থান নেওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
জাতীয় পার্টির দলীয় বৈঠকে আগামী ২৮ জুন সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দলটির সম্মেলন স্থগিত করেছেন জি এম কাদের। এককভাবে সম্মেলন স্থগিত করায় দলের মধ্যে বিভক্তি আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন দলের নেতারা।
গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জি এম কাদেরের সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে আগের নির্ধারিত দিনেই সম্মেলনের কথা জানিয়েছেন দলের দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার।
Advertisement
দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কিছু ইস্যুতে চেয়ারম্যান জি এম কাদের ছাড় দিতে চাইছেন না এবং তার এই অনড় অবস্থান নেওয়ার কারণেই বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
অন্যদিকে জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পার্টির চেয়ারম্যানকে ছাড়া কোনো সম্মেলন বৈধ হবে না। চলমান পরিস্থিতির জের ধরে কেউ দল ভাঙার চেষ্টা করলেও সেটি সফল হবে না বলে মনে করছেন তারা।
জি এম কাদেরের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে, পুরো বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন।
১৯৯০ সালে আন্দোলনের মুখে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভাঙনের শিকার হয়েছে দলটি।
Advertisement
সবশেষ গত কয়েক বছরে দলের কর্তৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়েই জি এম কাদের ও প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ হয়েছে বহুবার।
উভয় অংশই বিভিন্ন সময়ে গত শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ রাখার বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে সবসময়ই আলোচনার বিষয় ছিলো।
কেন এই সংকট?জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধান যে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের তার বৈঠকে ডেকেছিলেন সেখানে জাতীয় পার্টিও ছিলো। কিন্তু এরপর প্রধান উপদেষ্টা যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন তখন সেই আলোচনায় আর ডাক পায়নি দলটি।
বরং শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনকারীরা ‘জাতীয় পার্টি স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে প্রচার শুরু করেন এবং দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঘোষণা দিয়ে হামলার চেষ্টা করেছেন। এসবের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন থেকেও জাতীয় পার্টিকে সম্মেলনের জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা।
এমন পটভূমিতে দলটির গত ২০ মে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আগামী ২৮ জুন সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সম্মেলনের জন্য বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পাওয়া যায়নি জানিয়ে সম্মেলন স্থগিত করেছেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
এর আগে দলের বৈঠকে আলোচনার সময় দলটির গঠনতন্ত্রের একটি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব উঠেছে। ২০(ক) হিসেবে পরিচিত ওই ধারা অনুযায়ী, দলের চেয়ারম্যান যে কোনো সময় যে কোনো পদবির নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা সম্মেলনকে সামনে রেখে এই ধারা গঠনতন্ত্র থেকে বাদ দেয়া ও ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের দাবি তোলেন।
কিন্তু তাদের অভিযোগ, জি এম কাদের এসব প্রস্তাব মানতে রাজি হচ্ছেন না এবং পরিস্থিতি সামাল দিতেই তিনি সম্মেলন স্থগিত করেছেন।
দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো, গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের ‘যাকে ইচ্ছে তাকে বাদ দেওয়ার’ ক্ষমতা বাতিল নিয়ে জি এম কাদেরের সঙ্গে এবারের বিরোধ তৈরি হয়েছে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের।
তারা তিনজনই বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা হয়েও বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, দলের বৈঠকে পার্টির টাকা-পয়সার হিসাব ও গণতন্ত্রায়নের কথা এসেছে।
‘এখন চেয়ারম্যান যে কোনো পদের নেতাকে দল থেকে বের করে দিতে পারেন। এটা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র চর্চার কথা বলা হয়েছে। আমি নিজেও চেয়ারম্যানকে বলেছি অগণতান্ত্রিক এই ধারা বাদ দিতে সম্মত হতে। উনি এখনো রাজি হননি। বরং ভেন্যু না পাওয়ার কথা বলে তিনি এককভাবে সম্মেলন স্থগিত করেছেন,’ বলছিলেন মুজিবুল হক চুন্নু।
তবে জি এম কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলছেন, দলীয় কাউন্সিল রাস্তায় হতে পারে না এবং সে কারণেই চেয়ারম্যান এটি স্থগিত করেছন মাত্র।
‘এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদের সঙ্গে সমস্যা হয়েছে বলে হয়তো কেউ কেউ হয়তো ঝামেলা এড়াতে চাইছেন। কিন্তু দল ভেঙে আগেও কেউ সফল হয়নি, এখনো হবে না’, বলছিলেন তিনি।
কিন্তু দল ভাঙার চেষ্টার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন দলটির প্রেসিডিয়ামের আরেকজন সদস্য মাসরুর মাওলা। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, যাদের দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং যারা চলে গেছেন এমন অনেককেই বরং ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
‘কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে দলে এককভাবে ইচ্ছে মতো যাকে তাকে যখন তখন বাদ দেওয়া হচ্ছে। সেজন্যই গঠনতন্ত্র সংশোধনীর প্রস্তাব এসেছে। চেয়ারম্যান বিষয়টিকে ইতিবাচক নিলেই আর কোনো সংকট থাকবে না। তার নেতৃত্বেই সবাইকে নিয়ে দল এগিয়ে যাবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মাসরুর মাওলা।
জাতীয় পার্টির বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউন্সিল হলে সেখানে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদে প্রার্থী হতে পারেন।
অন্যদিকে বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলছেন, চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে তিনি জানিয়েছেন যে দলে গণতন্ত্রায়নের প্রস্তাব গ্রহণে তিনি সম্মত হলে তার সঙ্গে মহাসচিব হিসেবে থাকবেন তিনি।
‘আমি ওনাকে বলেছি আমি ওনার সঙ্গে থাকবো। কিন্তু প্রস্তাবে তিনি না করলে থাকবো না। ওনি এখনো রাজি হননি। তিনি রাজি নাহলে ওনার সঙ্গে মহাসচিব প্রার্থী হবো কি-না তা আমি নিশ্চিত নই,’ বলছিলেন মুজিবুল হক চুন্নু।
প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলছেন, যারা এখন চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কমাতে চাইছেন তাদের সামনেই কিন্তু আগে একই কায়দায় মহাসচিব পরিবর্তন হয়েছে।
‘বাস্তবতা হচ্ছে জাতীয় পার্টি অনেক বার ভেঙেছে। দলটি সবসময় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। সে কারণে চেয়ারম্যানের এমন ক্ষমতা না থাকলে দল চালানো মুশকিল হয়ে যায়। তারপরেও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
অন্যদিকে মাসরুর মাওলা বলছেন, কাউন্সিলে যদি কেউ কোনো পদের জন্য ভোটে দাঁড়াতে চায় সেই সুযোগ থাকা উচিত এবং দলের চেয়ারম্যানকেও সেটি ইতিবাচকভাবে নেওয়া উচিত।
‘যে কেউ প্রার্থী হতে পারে, ক্ষতি কী তাতে। গত নির্বাচনের (২০২৪ সালের জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন) আগেও অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে। তারও আগে অনেকে দল ছেড়ে গেছেন বা বাদ পড়েছেন। তাদের সবাইকে নিয়ে আসা হলে দল শক্তিশালী হবে,’ বলছিলেন মাসরুর মাওলা।
তিনি বলেন, চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদের সহযোগিতা করলে এবারের কাউন্সিলেই নতুন করে ঐক্য তৈরি হবে, যা দলকে সামনে এগিয়ে নিবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমএমএআর/জেআইএম