• করোনা আতঙ্কে বন্ধ ২৫ বেডের পিআইসিইউ• আতঙ্কের কিছু নেই, বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা• রোগ প্রতিরোধে জোর দেওয়ার তাগিদ• হচ্ছে না করোনা টেস্ট
Advertisement
রাইসার বয়স পাঁচ। গত দুদিন জ্বর। বাবা-মা আতঙ্কে নিয়ে এসেছেন শ্যামলীর শিশু হাসপাতালে। আসলে কী হয়েছে বুঝতে চান তারা। সকালে এসেই ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করিয়ে বসে আছেন রিপোর্টের জন্য।
রোববার (২২ জুন) বেলা ১১টার রাজধানীর শিশু হাসপাতালে গিয়ে চোখে পড়ে রাইসার মতো অনেক রোগী। চেয়ারে জায়গা না পেয়ে মাটিতেই বসে গেছেন অনেকে। করিডোরে বসে থাকা রাইসার মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জ্বর হলেই ভয় লাগে। ডেঙ্গু হলো কি না, বা করোনা কি না। এমন আতঙ্কেই মূলত এখন হাসপাতালে আসছি। সকালে এসেই ডাক্তার দেখিয়েছি। পরীক্ষাও হয়েছে। রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। এখানে একটু ঠান্ডা তাই মাটিতেই বসে গেছি।’
শুধু করিডোর নয়, হাসপাতাল ভবনের বাইরে গাছ তলা বা ফটকের সামনে ছায়ায় বাচ্চাদের নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় অভিভাবকদের। আবু সাঈদ (৬) বাবার সঙ্গে এসেছে বরিশাল থেকে। তার নিউমোনিয়া। ভর্তি দিয়েছেন চিকিৎসক। সিট খালি হবে তিনটায়, তাই করিডোরে বসে আছেন। তার বাবা বলেন, সিট তো দেয় না। লোক থাকলে কথা বলে নেওয়া যায়।
Advertisement
এদের মতো জামালপুর থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছে জোবায়ের (১১)। ঘাড় সোজা করতে পারে না। খিঁচুনি হয়। ডাক্তার দেখিয়েছেন। ইইজি করতে দিয়েছে, সিরিয়াল পড়েছে আগামী মাসের ৭ তারিখ। কী করবেন তা নিয়েই বসে কথা বলছেন স্বামী-স্ত্রী।
পাশেরজন মোহাম্মদপুর থেকে এসেছে। নাম ফাতেমা (৫)। তার বুকে ব্যথা, খায় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্টের জন্য সিরিয়ালে আছে।
এদের মতো হাজারও রোগীর চাপ রাজধানীর শিশু হাসপাতালে। গতকালের (২১ জুন শনিবার) তথ্য বলছে, বহির্বিভাগে ১২শ ১৮ জন রোগী এসেছে। নিউমোনিয়া নিয়ে ৩১, কমন সর্দি ১৬২, অ্যাজমা ১৯, স্ক্যাবিস ৮৯, স্কিনের ২২৩, ডায়রিয়ার ৫০ জন উল্লেখযোগ্য। এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি আছে ১৩শ ২৪ জন রোগী। এর মধ্যে ডেঙ্গুর ৬৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১২১ জন নতুন ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে একজন।
রোগীর চাপ একটু বেশি। এখন জ্বর-সর্দি হলেই বাবা-মা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ডেঙ্গু বা করোনা হয়েছে কি না সেই সন্দেহ থেকে। আমাদের এখানে ডেঙ্গু টেস্ট হয় নিয়মিত। তবে করোনা টেস্ট করছি না।- আবাসিক চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হক চৌধুরী
Advertisement
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোগীর চাপ একটু বেশি। এখন জ্বর-সর্দি হলেই বাবা-মা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ডেঙ্গু বা করোনা হয়েছে কি না সেই সন্দেহ থেকে। আমাদের এখানে ডেঙ্গু টেস্ট হয় নিয়মিত। তবে করোনা টেস্ট করছি না। পাশেই সরকারি ল্যাবরেটরি ইন্সটিটিউট থেকে করোনা টেস্ট করানো যায়। বললে তারা এসেও স্যাম্পল নিয়ে যায়। আমরা ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু করেছি। ছয় বেডের ওয়ার্ড। তিনটি ফ্রি, তিনটিতে টাকা দিয়ে থাকবে।’
করোনা টেস্ট হয় না, বন্ধ পিআইসিউসরকার বললেও আপাতত করোনা টেস্ট করাচ্ছে না রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউট। পাশাপাশি গত সপ্তাহ থেকে বন্ধ প্রতিষ্ঠানটির পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ)। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার থেকে বলছে, আমরা করোনা টেস্ট চালু করতে পারছি না। করোনা আতঙ্কে আমাদের ২৫ বেডের পিআইসিইউ বন্ধ। গত সপ্তাহে পিআইসিইউর একটা বাচ্চার মধ্যে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়। যার কারণে আমরা সেটি বন্ধ রেখেছি। সব প্রস্তুতি শেষ করে আগামী দিন (২৩ জুন) থেকে চালু হবে।’
আতঙ্ক নয়, সাবধান হওয়ার পরামর্শস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘রোগ নির্ণয়ে আমাদের কার্যক্রম চলমান। চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতাল, বিভিন্ন হাসপাতালে ডেডিকেটেড ইউনিট আমরা করেছি। অতএব, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বর্তমান প্রস্তুতি রোগীর চাপ ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী যথেষ্ট।’
বিশ্বের পরিস্থিতি, বাংলাদেশে যে পরিমাণ রোগী এবং পরীক্ষার যে হার, তাতে বোঝা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে সেই মাত্রায় লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানুষ তো লক্ষণ দেখা দিলে বা কষ্ট পেলে হাসপাতালে আসতেন। রোগীর চাপ ও বিশ্বের পরিস্থিতি অনুযায়ী আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।- প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের পরিস্থিতি, বাংলাদেশে যে পরিমাণ রোগী এবং পরীক্ষার যে হার, তাতে বোঝা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে সেই মাত্রায় লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানুষ তো লক্ষণ দেখা দিলে বা কষ্ট পেলে হাসপাতালে আসতেন। রোগীর চাপ ও বিশ্বের পরিস্থিতি অনুযায়ী আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া হয় এডিস মশা থেকে। বাচ্চাদের যাতে মশা কামড়াতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সব সময় ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখা, ঘুমাতে গেলে দিনে ও রাতে মশারি টানানো প্রয়োজন। এডিস মশা জমা পানিতে ডিম পাড়ে, বংশ বিস্তার করে। এজন্য কোথাও যেন জমা পানি না থাকে। ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টব, ছাদ বাগান, ঘরের চতুর্পাশ, এমনকি বাথরুমের কমোডেও। পাশাপাশি ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ঘরের বাইরের দায়িত্ব প্রশাসনের, যেন কোথাও জমা পানি না থাকে। সড়কে বা খালি জায়গায় পরিত্যক্ত টায়ার, চিপসের প্যাকেট, পরিত্যক্ত হাঁড়ি, প্লাস্টিকের চায়ের কাপ পড়ে থাকে। এগুলোতেও মশা ডিম পাড়ে। আগে বলা হতো পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে এডিস মশা, এখন নোংরা পানিতেও ডিম পাড়ে। প্রশাসন ও জনগণ মিলে সবার সমন্বিত পদক্ষেপে মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে আমাদের রেহাই নেই। যে হারে বাড়ছে, আরও বাড়বে।’
আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া হয় এডিস মশা থেকে। বাচ্চাদের যাতে মশা কামড়াতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সব সময় ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখা, ঘুমাতে গেলে দিনে ও রাতে মশারি টানানো প্রয়োজন।- ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই ডেঙ্গু বাড়ে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময়টাই ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়ে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার প্রধানতম উপায় হলো এডিস মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া। ঘরের ভেতরে বা আশপাশে যেন পানি না জমে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। জমলে ফেলে দিতে হবে। প্লাস্টিকের ড্রাম বা মাটির মটকিতে অনেকে পানি সংরক্ষণ করেন। এসব পানি তিনদিনের বেশি রাখা যাবে না। তিনদিনেও ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে। না হয়, এডিস মশা এসে ডিম পাড়বে।’
জ্বর-সর্দিতে টেস্ট করান, নিয়ম মেনে চলুনযে কারও জ্বর-সর্দি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা হলেই ডেঙ্গু ও করোনা টেস্ট করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জ্বর হলে এক-দু-দিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নেবেন। প্রচুর পানি বা নানা ধরনের জুস পান করতে হবে। জ্বর হয়ে দুর্বলতা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ
এ বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘লক্ষণ দেখা গেলেই পরীক্ষা করতে হবে। বেশিরভাগ রোগীর কিন্তু ঘরে বসেই চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব। প্যারাসিটামলের বাইরে কোনো ওষুধ খাবে না। প্রচুর পানি খাবে, ডাব, ওরস্যালাইন, গ্লুকোজ, ফলমূলের রস খাবে। আর যদি খেতে না পারে, বমি হয়, পাতলা পায়খানা হয়, অথবা যাদের অন্য রোগ আছে; ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, কিডনি, লিভার ও ক্যানসারের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়া ভালো। বয়স্ক, ছোট বাচ্চা ও নারীদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।’ বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘জ্বর হলে এক-দু-দিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নেবেন। প্রচুর পানি বা নানা ধরনের জুস পান করতে হবে। জ্বর হয়ে দুর্বলতা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’
এসইউজে/এএসএ/এমএস