২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিতর্কিত একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ‘দিনের ভোট রাতে’ করার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। নির্বাচন পরিচালনা করেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। ফলে নির্বাচনের পর থেকে নূরুল হুদাকে ‘রাতের ভোটের’ সিইসি বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এছাড়া নানা কারণে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কাদা-ছোড়াছুড়িও ছিল তীব্র।
Advertisement
রোববার (২২ জুন) রাজধানীর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে সাবেক সিইসি নূরুল হুদাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয় জনতা। পরে বিএনপির করা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। নূরুল হুদাকে গ্রেফতারের পর তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। নেটিজেনরাও সাবেক এ সিইসির কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ তার সে সময়ের নানা বক্তব্য-বিবৃতি নিয়ে হাসি-ঠাট্টায়ও মেতেছেন।
এক নজরে কে এম নূরুল হুদারাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটির মাধ্যমে সিইসি পদে নিয়োগ পান কে এম নূরুল হুদা। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সিইসি পদে যোগদান করেন। ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে কমিশনের দায়িত্ব ছাড়েন। তার অধীনে বিতর্কিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) ও রংপুর সিটি করপোরশেরন (রসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসনে জয়লাভ করে। আর বিএনপি আসন পায় মাত্র ছয়টি, যা নিয়ে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনাস্থা জানাতে থাকে। জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় নির্বাচনেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়।
Advertisement
আরও পড়ুন
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা গ্রেফতার সাবেক সিইসি নুরুল হুদা ডিবি কার্যালয়ে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে গেলেন নূরুল হুদা’আলোচিত যত বক্তব্য-বিবৃতিদায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের আয়োজন করে নূরুল হুদা কমিশন। সেই সংলাপে সবগুলো দল অংশ নেয়। বিএনপির সঙ্গে সংলাপের ওই বছরের ১৫ অক্টোবর সূচনা বক্তব্যে সিইসি বলেন ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৩৯ বছর আগে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ৭৭ সালে বিএনপি গঠন করেন। সেই দল ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব মতাদর্শের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে একত্র করে, তার মধ্যদিয়েই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে।’ ওইদিন বিএনপির নেতারাও বেশ ‘আশাবাদী’ হতে দেখা যায়।
‘৪-৫ মিনিটে ভোট গুনে ফেলি..’ঢাকা-১৮ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর বিতর্কিত এক মন্তব্য করেন তৎকালীন সিইসি নূরুল হুদা। ভোট গণনার ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কিছু শেখার রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নূরুল হুদা সেদিন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ৪ থেকে ৫ দিনে ভোট গুনতে পারে না। আমরা ৪ থেকে ৫ মিনিটে গুনে ফেলি। যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের কাছে শেখার আছে।’
Advertisement
‘দিনের ভোট রাতে হওয়া নিয়ে মোটেও বিব্রত নই’২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার মেয়াদের শেষদিনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে মোটেও বিব্রত নন বলে মন্তব্য করেন নূরুল হুদা। যা তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়েন।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আজকের পর সমাজে আপনাদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন নানা সোসাইটিতে নানা মানুষের সঙ্গে আপনাদের দেখা হবে। আপনারা কোনো কারণে নিজেদের মধ্যে বিব্রতবোধ করবেন কি না, যে নির্বাচনব্যবস্থার যে অবস্থা আমরা দেখছিলাম...।’
এর জবাবে নূরুল হুদা বলেন, ‘মোটেই না। মোটেই না।’ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের দেওয়া তার সেদিনের যুক্তি হচ্ছে, ‘নির্বাচনে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে নির্বাচনের আইনকানুন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির কোনো অভাব রাখিনি। সে রকম নির্বাচন আমরা এখানে করার চেষ্টা করেছি। সুতরাং, সেখানে আমরা বিব্রত নই, কোনো দুর্বলতা নেই।’
নূরুল হুদার পরিচয়বিসিএস ১৯৭৩ সালের একজন সদস্য হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন কে এম নূরুল হুদা। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসরে যান। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরুর পর কুমিল্লা ও ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং সংসদ সচিবালয় যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
২০১০ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ মিউনিসিপাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে (বিএমডিএফ)। বিএমডিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ছিলেন পাঁচ বছর। এর আগে জেমকন গ্রুপের পরিচালক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ), নর্থ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন নূরুল হুদা।
১৯৪৮ সালে পটুয়াখালীর বাউফলে জন্মগ্রহণ করেন কে এম নূরুল হুদা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। এছাড়া ১৯৭২-৭৩ সালে হল ছাত্রসংসদে সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন নূরুল হুদা। তিনি যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্রাবস্থায় বরিশাল অঞ্চলে মেজর জলিলের নেতৃত্বে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন।
স্ত্রী হুসনে আরার সঙ্গে নূরুল হুদার সংসারে তিন ছেলে-মেয়ে। বড় ছেলে প্রকৌশলী, থাকেন কানাডায়। মেজ মেয়ে বুয়েট থেকে পাস করে পিএইচডি শেষে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে থাকেন। ছোট মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য কানাডায় রয়েছেন।
এএএইচ/এমএএইচ/এমএস