ফাহিম হাসনাত
Advertisement
নরসিংদীর মাটি যেন নিজ হাতে ফলের ঝাঁপি সাজিয়ে বসে আছে। সুগন্ধি সাগর কলা, রসালো ঘোড়াশালের আনারস আর মুখরোচক লটকন—তিনটি ফল যেন নরসিংদীর রত্ন। একসময় এ ফলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। আজও তাদের গন্ধ-রং-রস গায়ে মেখে বহন করে বেড়ায় ঐতিহ্যবাহী কৃষির গল্প, জেলার হৃদয়ের ইতিহাস।
সোনালি দিনের কলা: হারানো গৌরবনরসিংদীর নাম উঠলেই সবার প্রথমে মনে আসতো কলার কথা। বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও বুনো কলা, কাঁঠাল আর আনারসের স্বাদ উপভোগ করতো এলাকাবাসী। সময়ের পরিক্রমায় এখানকার কলাবাগানগুলো তৈরি করেছিল এক মনমুগ্ধকর দৃশ্য। নরসিংদীর কলার স্বাদ, গন্ধ আর গুণাগুণ ছিল অতুলনীয়। যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। বাংলার অনেক শাসক তাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় নরসিংদীর কলা রাখতেন।
কলার কদর এতটাই ছিল যে, পাটের পরেই এটি ছিল নরসিংদীর মানুষের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল। কলা চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী স্থানীয় অর্থনীতি। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, নরসিংদীর পাহাড়ি ও সমতল ভূমির বয়স প্রায় ১০ হাজার বছর। কলার উৎপত্তিস্থল এশিয়া হওয়ায় ধারণা করা হয়, কৃষির শুরু থেকেই; এমনকি ধান চাষের সমসাময়িক কাল থেকেই নরসিংদীতে কলা চাষ হতো।
Advertisement
ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষ হতো। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার হেক্টরজুড়েই ছিল সুস্বাদু সাগর কলা। এ ছাড়া সবরি, কবরি, চম্পা, চিনি চম্পা, অগ্নিসাগরসহ বিভিন্ন জাতের কলার চাষ হতো। উৎপাদিত কলার পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ লাখ টন। এ বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল প্রায় এক থেকে দেড় লাখ মানুষ।
নরসিংদী থেকে উৎপাদিত কলা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে; এমনকি রাজধানীতেও রপ্তানি করা হতো। পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি লোকাল ট্রেনের নামকরণ করা হয়েছিল ‘কলার গাড়ি’। প্রতিদিন বিকেলে দৌলতকান্দী, শ্রীনিধি, মেথিকান্দী, খানাবাড়ী, আমীরগঞ্জ, নরসিংদী, জিনারদী, ঘোড়াশালসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে হাজার হাজার টুকরি কলা জমা হতো। যা সন্ধ্যার পর কলার গাড়িতে তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো।
ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেললাইনে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনেই কলার বগি থাকতো। শত শত হকার ট্রেনের কামরায় নরসিংদীর পাকা কলা বিক্রি করতেন। একইভাবে লঞ্চ, স্টিমার ও বাসেও নরসিংদীর কলার সরব উপস্থিতি ছিল। নতুন জামাইরা শ্বশুরবাড়ি গেলে ডাউস আকারের হলদে পাকা সাগর বা সবরি কলার কাঁদি নিয়ে যেত, যা তাদের কদর আরও বাড়িয়ে দিতো।
বাগানে কলা পাকলে চাষিরা আস্ত কলার ছড়ি কেটে মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে পাঠাতেন। কলার অতিরিক্ত পুষ্টি ও ওষুধি গুণের কারণে কবিরাজরা রোগীদের কলা খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। এমনকি দুধেল গাভিকেও অতিরিক্ত দুধের আশায় পাকা কলা খেতে দেওয়া হতো। কলার এ বহুমুখী ব্যবহারের কারণেই নরসিংদীর মানুষ পাহাড়ি ও সমতল ভূমিতে আনন্দের সঙ্গে কলা চাষ করতো।
Advertisement
আরও পড়ুন
ঝিনাইদহে বিদেশি ফল চাষে সম্ভাবনা, আগ্রহী কৃষকেরা মেহেরপুরে মিয়াজাকি আম চাষ, বিশ্বে কেজি ২ লাখ টাকাসবচেয়ে বেশি কলা চাষ হতো মনোহরদী উপজেলায়। যেখানে চালাকর, সাগরদী, মনোহরদী, হাতিরদিয়াসহ বেশ কয়েকটি কলার বাজার গড়ে উঠেছিল। এসব বাজার থেকে ট্রাকে ভর্তি হয়ে কলা যেত ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে। পলাশের চরসিন্দুর, গজারিয়া, তালতলী, পারুলিয়া, কালির বাজার, রাবান বাজার, চরনগরদী, নরসিংদীর ভাটপাড়া, শীলমান্দী, শিবপুরের ফতেপুর, সিঅ্যান্ডবি, পালপাড়াসহ অন্য বাজারেও হাজার হাজার টন কলা আমদানি ও রপ্তানি হতো।
কলার বর্তমান অবস্থাদুঃখজনক হলেও সত্য, নরসিংদীর কলার সেই সুদিন আর নেই। কলা চাষ এখন ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে দেশি জাতের সুস্বাদু ও সুগন্ধি সাগর কলার উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এর স্থান দখল করেছে নেপালি সাগর কলা, যা স্বাদে ও গন্ধে ততটা ভালো না হলেও ফলন বেশি এবং রোগবালাই কম। এ ছাড়া চম্পা ও সবরি কলার চাষ হচ্ছে। তবে চাষিরা কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাচ্ছেন না।
সচেতন চাষিরা বলছেন, দেশি জাতের সাগর কলা আমাদের ঐতিহ্য। এ কলার জাত সংরক্ষণে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে কাজ করতে হবে। গবেষকরা যদি নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে দেশি জাতের সাগর কলার উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে পারেন, তবেই চাষিরা আবার কলা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
আনারস: নরসিংদীর গৌরবকলা ছাড়াও নরসিংদীর আরেকটি জনপ্রিয় ফল হলো আনারস। এটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, সুস্বাদু ও রসালো ফল। দেখতে সুন্দর ফলটি কলি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং খাওয়ার উপযোগী হলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এর ওজন সাধারণত ৪০০ গ্রাম থেকে ২০০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশে মূলত তিন জাতের আনারস দেখা যায়: জলডুবি, ক্যালেঙ্গা বা ক্যালেন্ডার এবং ঘোড়াশাল। নরসিংদী জেলার ঘোড়াশাল অঞ্চলে চাষ হওয়া আনারসের নামকরণ করা হয়েছে ‘ঘোড়াশাল’ আনারস।
পলাশ উপজেলার রাবান, জিনারদী ও আশেপাশের অঞ্চল এবং বেলাবো উপজেলার পাটুলি, বাজনাব, আমলাব ও তার আশেপাশের এলাকার চাষিরা আনারস চাষ করে বছরে প্রায় ৩০-৫০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। বর্তমানে হানিকুইন প্রজাতির আনারসের চাষ বেশি হচ্ছে, যার পূর্বনাম ছিল জলডুবি। বর্তমানে জেলার ঘোড়াশাল-বেলাবো অঞ্চলে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হচ্ছে। কৃষিপণ্যটি এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চাষ হওয়ায় চাষিরা ততটা লাভবান হতে পারছেন না। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করা হলে বেশি লাভবান হতেন।
লটকন: বিশেষ ফলনরসিংদীর শিবপুর উপজেলার অসংখ্য ফলের মধ্যে লটকন অত্যন্ত মুখরোচক ও টক-মিষ্টি স্বাদের। ছোট গোলাকার হলুদাভ ফলটিকে ইংরেজিতে বার্মিজ গ্রেপ বলা হয়, যার বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea ramiflora। এ রসালো ও মজাদার ফলের ভেতরে ২-৪টি বীজ কোয়ার মতো থাকে। বীজের চারপাশ ঘিরে এক প্রকার রসালো পদার্থ থাকে, যা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এ ফলের ঘ্রাণও বেশ মনোরম। দেশে-বিদেশে এ ফলের চাহিদা থাকায় শিবপুরের পাহাড়ি এলাকা, বেলাবো ও মনোহরদী উপজেলার শত শত চাষি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন। ফল বিক্রি করে বছরে এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করেন।
লটকন গাছ মাঝারি আকারের চিরসবুজ উদ্ভিদ, যা ২০-২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পুরো কাণ্ডজুড়ে থোকায় থোকায় ফল ধরে। একটি থোকায় ৭-১৫টি ফল ধরে এবং একেকটি ফলের ওজন ১৫-২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়। গাছ রোপণ করার দুই-তিন বছরের মধ্যেই ফল ধরা শুরু করে এবং ২০-৩০ বছর পর্যন্ত ফল দিতে থাকে। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর চাহিদা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বেড়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুস্বাদু ফলটির চাষ সম্প্রসারণ করা দরকার।
নরসিংদীর ফলগুলো শুধু মাটির ফসল নয়; এ অঞ্চলের মানুষের পরিশ্রম, ঐতিহ্য আর ভালোবাসার প্রতীক। কলার সুদিন ফেরাতে, আনারস ও লটকনের চাষ আরও সম্প্রসারণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। তাহলে নরসিংদী আবার পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে।
লেখক: ফিচার ও কলাম লেখক।
এসইউ/এমএস