বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইমেজ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আচরণগত বিতর্ক ও নেতৃত্ব কাঠামো নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দলের অবস্থান ও জনআস্থার প্রশ্নে একদিকে যেমন আশাবাদ, অন্যদিকে আছে নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা।
Advertisement
এসব বিষয়ে জাগো নিউজ কথা বলেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোবাশ্বের টুটুলের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক খালিদ হোসেন।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি বিএনপির রাজনৈতিক ইমেজ নিয়ে নানান বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনার বিশ্লেষণে এ সংকটের মূল কারণ কী?
মোবাশ্বের টুটুল: বিএনপির রাজনৈতিক ইমেজ আমি দুই ভাগে দেখি—একটা হচ্ছে দলীয় সিদ্ধান্ত, আরেকটা নেতাকর্মীদের আচরণ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পলায়নের পর বিএনপি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবে তারা গঠনমূলক অবস্থান নিয়েছে, জাতিসংঘ ও বিদেশি মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে এবং সরকারের প্রতিটি সংস্কার প্রক্রিয়ায় মতামত দিয়েছে।
Advertisement
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ইমেজ সংকটে ভূমিকা রাখছে। যাচাই না করে অনেক কিছু ভাইরাল হয়। সেই সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা
আরও পড়ুন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্লোগান, বিএনপির ভবিষ্যৎ কোন পথে? অন্তর্ঘাতে রক্তাক্ত বিএনপি, ভেতরে বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া বিশ্ব বদলে গেছে, দেশ গড়তে মেধাবী রাজনীতিবিদ লাগবেতবে ইমেজ সংকটের আসল জায়গাটা নেতাকর্মীদের আচরণ। টানা ১৭ বছরের নির্যাতনের পর শেখ হাসিনার পতনের সময় অনেকে নিজেকে সামলাতে পারেননি। অনেকে ইনফর্মাল অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে—যেমন, চাঁদাবাজি, বাজার নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতা প্রদর্শন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অধিকাংশই ভোটপ্রার্থী নয়—জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহি নেই। ফলে এটাই নেতিবাচক ইমেজের বড় কারণ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ইমেজ সংকটে ভূমিকা রাখছে। যাচাই না করে অনেক কিছু ভাইরাল হয়। সেই সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা।
জাগো নিউজ: দলীয় অভ্যন্তরীণ সহিংসতা, পদ বাণিজ্য ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা দলের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য কতটা হুমকি?
Advertisement
মোবাশ্বের টুটুল: রাজনীতিতে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা থাকবেই। কিন্তু সেটা যদি ‘নীতির’ বদলে ‘কৌশল আর লেনদেনে’ রূপ নেয়—তাহলেই সমস্যা। আমাদের সাংস্কৃতিক কাঠামোতে সবাই জিততে চায়। সেই জেতার পেছনে অর্থ ব্যয় করে মিছিল-মিটিং করে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ফলে পদবাণিজ্য, মনোনয়নবাণিজ্য, পকেট কমিটি—এসব চলে আসে।
বিএনপির উচিত হবে একটি অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ও পুরস্কার-শাস্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির ওপর রাজনীতির নির্ভরতা কমাতে হবে। তা না হলে এই অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দীর্ঘমেয়াদে দলের ক্ষতি করবে
বিএনপির উচিত হবে একটি অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ও পুরস্কার-শাস্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির ওপর রাজনীতির নির্ভরতা কমাতে হবে। তা না হলে এ অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দীর্ঘমেয়াদে দলের ক্ষতি করবে।
জাগো নিউজ: বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে, সেটা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?
মোবাশ্বের টুটুল: রাজনৈতিক দল মানেই মতপার্থক্যের প্ল্যাটফর্ম। এটাকে মিলিটারিস্টিক ডিসিপ্লিন দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। তবে দল যদি একটা স্পষ্ট পাবলিক স্পিকিং গাইডলাইন তৈরি করে, যেখানে বলা থাকবে কোন বিষয় কীভাবে প্রকাশ করতে হবে, তাহলে নেতাকর্মীদের বক্তব্যে এক ধরনের ঐক্য আসবে।
ঘোষিত শুদ্ধি অভিযান বাস্তবায়ন করতে হবে। ভালো কাজের প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে এবং তা প্রচার করতে হবে—এ প্রতিযোগিতাই একদিন বিএনপির শক্তি হয়ে উঠবে
এছাড়া দল প্রশিক্ষণের দিকে নজর দিলে, নেতাকর্মীরা বাস্তবতা বুঝে আরও দায়িত্বশীল হবে। ইতোমধ্যে বিএনপি এ উদ্যোগ শুরু করেছে। আশা করা যায় আগামীতে এর ফল মিলবে।
জাগো নিউজ: আপনি কি মনে করেন বিএনপি তার রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মসূচির মাধ্যমে জনআস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে?
মোবাশ্বের টুটুল: আমি মনে করি, বিএনপির প্রতি জনগণের আস্থা এখনো অটুট। তবে আরও ভালো করার সুযোগ আছে। এখন পর্যন্ত বড় কোনো এমপি প্রার্থী বা কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে বড় দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন যে নেতিবাচক কথাবার্তা শুনতেই বেশি পছন্দ করে মানুষ। কিন্তু ভোট দেয় বাস্তবতা দেখে। সেই হিসেবে বিএনপিকে ‘টেস্টেড অ্যান্ড ট্রাস্টেড’ শক্তি হিসেবে এখনো মানুষ বিবেচনা করে।
জাগো নিউজ: বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামো ও তারেক রহমানের ভূমিকা এই সংকট মোকাবিলায় কতটা কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?
মোবাশ্বের টুটুল: দল দীর্ঘদিন কাউন্সিল করতে পারেনি, এতে নেতৃত্ব কাঠামোয় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবে তারেক রহমানের অবস্থান জনগণের আবেগ ও পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্র ধরে এখনো শক্তিশালী।
তিনি একক সিদ্ধান্তে দল চালান না। স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেন। তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে থাকলেও প্রতিনিয়ত দলীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই যৌথ নেতৃত্ব প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে বিএনপি সংকট মোকাবিলায় আরও কার্যকর হবে।
জাগো নিউজ: বর্তমান সরকারের নীতি ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা কি বিএনপির ইমেজ সংকট আরও গভীর করেছে?
মোবাশ্বের টুটুল: নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণ, দলীয় পছন্দে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, কিছু মিডিয়া ব্যবস্থাপনার কারণে বিএনপির সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে প্রশাসনের মধ্যে প্রশিক্ষণবিহীন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে—এতে সুশাসনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তবে সরকারের সব পর্যায়ে বিএনপিবিরোধী মনোভাব নেই। কিছু কিছু অংশে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সুবিধা দিতে গিয়ে পক্ষপাত দেখা যায়।
জাগো নিউজ: আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির কী ধরনের সংস্কার বা উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত?
মোবাশ্বের টুটুল: বিএনপি ইতোমধ্যে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যার মধ্য দিয়ে তারা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরছে। এই ৩১ দফার ওপর ভিত্তি করেই সম্ভবত ইশতেহার তৈরি হবে।
মূল চ্যালেঞ্জ হবে মনোনয়ন দেওয়া ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সামাল দেওয়া। দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে নতুন নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ আসবে। এছাড়া বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে মার্জিত ও গ্রহণযোগ্য মানুষদের মনোনয়ন দিলে দলের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে।
জাগো নিউজ: যদি আপনি বিএনপিকে ইমেজ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি পরামর্শ দিতে চান সেটা কী হবে?
মোবাশ্বের টুটুল: প্রথমত, নেতাকর্মীদের আচরণবিধি তৈরি করতে হবে এবং সেটি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দলের অভ্যন্তরে পুরস্কার–শাস্তি পদ্ধতি চালু করতে হবে। প্রতি ছয় মাস অন্তর প্রত্যেক নেতার কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করতে হবে। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের অধীনস্থদের আচরণের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ঘোষিত শুদ্ধি অভিযান বাস্তবায়ন করতে হবে। ভালো কাজের প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে এবং তা প্রচার করতে হবে—এই প্রতিযোগিতাই একদিন বিএনপির শক্তি হয়ে উঠবে।
কেএইচ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম