চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌরুট উন্নয়নে ২০১৬ সালে প্রায় তিন হাজার দুইশ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহনের প্রধান এ রুটের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৬০ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকলেও অনেক কাজ এখনো শুরুই হয়নি। অনিশ্চয়তায় হাবুডুবু খাচ্ছে পুরো প্রকল্পের ভবিষ্যৎ।
Advertisement
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহনের প্রায় ৮০ শতাংশ এই রুট ব্যবহার করে। দেশের তিনটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা এ রুটের মাধ্যমে সংযুক্ত। রুটটির উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। অথচ ৯ বছরে অগ্রগতি মাত্র ৬০ শতাংশ। এই সময়ে প্রকল্পের বাকি কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। ফলে প্রকল্পটি অনিশ্চয়তায় পড়েছে। বাকি কাজ বাস্তবায়নেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে ৯ বছর আগে যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেও দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। বাস্তবায়নে দুর্বলতার কারণে বছরব্যাপী নৌযান চলাচল ব্যাহত হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
সম্প্রতি আইএমইডি ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রকল্প-১ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ ও সংযুক্ত নৌপথ খনন এবং টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ)’ প্রকল্প নিয়ে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে প্রকল্পের নানান দুর্বল দিক উঠে এসেছে। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে সরকারের একমাত্র প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান আইএমইডি।
প্রকল্পের দুর্বলতা প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নতুন সচিব হিসেবে আইএমইডিতে যোগদান করেছি। এসব রিপোর্ট আমার আসার আগেই প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ গিয়ার আপ করতে আমরা কাজ করছি। যেগুলো গিয়ার আপ করে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলোতে বেশি ফোকাস করছি। আর যদি দেখি সব কিছু করে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তাহলে সেগুলো বন্ধ করবো।’
Advertisement
এসব রিপোর্ট আমি আসার আগেই প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ গিয়ারআপ করতে আমরা কাজ করছি। যেগুলো গিয়ারআপ করে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলোতে বেশি ফোকাস করছি। আর যদি দেখি সব কিছু করে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তাহলে সেগুলো বন্ধ করবো।- আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রকল্প-১ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ) সংযুক্ত নৌপথ খনন এবং টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ’ প্রকল্পটি দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ধীরগতির বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানতে চাইবো।’
প্রকল্পের বাস্তবায়ন এলাকাপ্রকল্পটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল ও ভোলা জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ আঞ্চলিক করিডোরে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের দক্ষতা বাড়ানো, চলাচলকারী যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সামগ্রিকভাবে এ খাতের উন্নয়ন করা।
আরও পড়ুন গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে ইট-বালুতে ফাঁকি, প্রশ্নবিদ্ধ কাজ দক্ষ তরুণেরা বিনিয়োগমুখী না হলে বয়স্কদের সামনে মহাবিপদ আঁকাবাঁকা সড়ক মেরামতে ধীরগতি, পিডিকে দুষছে আইএমইডিএছাড়া নির্ধারিত নৌযানের সংখ্যা ১৫০ থেকে ৩৪৭টিতে উন্নীতকরণ, নৌ-সহায়ক সামগ্রীর বিদ্যমান প্রাপ্যতা ৩০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ বাড়ানো, দৈনিক নিরাপদ নাব্যকাল ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টায় উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ করিডোরে পরিবহন সময় ৪০ থেকে ৩০ ঘণ্টায় নামানো, প্রকল্পের টার্মিনালগুলোতে যাত্রীদের সন্তুষ্টির মাত্রা বাড়ানো।
Advertisement
ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও সংরক্ষণ ড্রেজিং, নৌ-সহায়ক সামগ্রী স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, নৌযানগুলোর জন্য দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণ, উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ, কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ, উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ কাজ বাস্তবায়ন, ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ, মাল্টিপারপাস ভেসেল এবং আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কথা থাকলেও তা অধরাই রয়ে গেছে।
প্রকল্পের মেয়াদ বেশিদিন বাকি নেই। মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। শুরু থেকে গড়ে ৬০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। শুরু থেকে তিন বছর পেপারওয়ার্কে চলে গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগেও দেরি হয়েছে।- প্রকল্পের পরিচালক মো. আইয়ুব আলী
প্রকল্পের পরিচালক মো. আইয়ুব আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ বেশিদিন বাকি নেই। মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। শুরু থেকে গড়ে ৬০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।’
ধীরগতি প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘শুরু থেকে তিন বছর পেপারওয়ার্কে চলে গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগেও দেরি হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌ-করিডোরের সঙ্গে বরিশালকে সংযুক্তকারী এ নৌ-রুটটির নাব্য বাড়াতে বিশ্বব্যাংকের আইডিএ ফান্ডের সহায়তায় বিআইডব্লিউটিএ তিন হাজার ২শ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০১৬ সালে একনেকে অনুমোদন হয়। প্রকল্পটিতে নতুন কিছু খাতের অন্তর্ভুক্তি, কতিপয় খাতের ব্যয় বাড়ানো এবং প্রকল্পের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পাদনে তিন হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় রেখে সংশোধন করা হয়। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধির আলোকে নিবিড় পরিবীক্ষণের কাজটি করে ‘অধুনা বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠানটির পরামর্শক দল।
আইএমইডি প্রতিবেদন বলছে, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। সংশোধিত প্রকল্পের অধীনে মোট ৬০টি প্যাকেজ দরপত্রের জন্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে সেবা-৩৭টি (১৭টি আলাদা পরামর্শক সেবা), পণ্য সরবরাহ-১২টি, পূর্তকাজ-৭টি এবং অপারামর্শক সেবা-৪টি। দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াধীন ১৪টি প্যাকেজের মধ্যে ৮টি প্যাকেজ প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ২০টি প্যাকেজ আহ্বান প্রক্রিয়াধীন। ১২টি প্যাকেজ সমাপ্ত হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই ক্রয় পরিকল্পনা অনুসারে ক্রয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্পের জনবল বিষয়ে ডিপিপিতে মোট ৪৮টি অনুমোদিত পদ রয়েছে, যার মধ্যে ২৭টি পদ শূন্য।
ফলে সময়মতো কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বিলম্বসহ প্রকল্পে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রকল্পে প্রতি তিন মাস অন্তর একটি করে সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও ১১টি প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রকল্পের দুর্বলতানির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের সব খাতের কাজ শেষ না হওয়া, স্পষ্ট এক্সিট প্ল্যানের অভাবের মতো কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। এছাড়া ডিপিপি প্রণয়নে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার অভাব, প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বাস্তবায়ন পর্যায়ে ক্রয় পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়া, জমি অধিগ্রহণ কাজে বিলম্ব প্রকল্পের অন্যতম প্রধান দুর্বল দিক। প্রকল্পটি থেকে নতুন প্রকল্পে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো, নদীর আইনগত সত্তা কাজে লাগিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর মতো সুযোগও তৈরি হবে। তবে নিয়মিত ড্রেজিং না করা গেলে নাব্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। ফলে বছরব্যাপী নৌযান চলাচল ব্যাহত হতে পারে।
সময়-ব্যয় বাড়ানো নিয়ে আইএমইডির পর্যবেক্ষণপ্রকল্পের কাজের সময় ও ব্যয় বাড়ানোর কয়েকটি কারণ জানিয়েছে আইএমইডি। প্রথমত, প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রায় এক বছর পর কাজ শুরু হয়। দ্বিতীয়ত, ৩৭টি দেশি-বিদেশি পরামর্শক সেবার আওতায় নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়। তৃতীয়ত, কোভিড-১৯ এর কারণে প্রায় দুই বছর সব ধরনের কাজে কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রকল্পের পূর্তকাজ অনুমোদিত ড্রইং-ডিজাইন অনুযায়ী সম্পাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে চলমান ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন করার পরে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করার জন্য মাত্র ছয় মাস সময় বর্তমান মেয়াদে অবশিষ্ট থাকবে।
চুক্তি অনুযায়ী মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করার জন্য ৩৬ মাস সময় প্রয়োজন। প্রকল্পের অডিট কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অডিটে পাঁচটি অর্থবছরে ১৪টি অডিট আপত্তির উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া ডিপিপিতে এ প্রকল্পের ‘এক্সিট প্ল্যান’ বিষয়ক কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। তবে প্রকল্পের কার্যক্রম টেকসইকরণের লক্ষ্যে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর ভৌত অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আইএমইডির সুপারিশনিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার মাধ্যমে চলমান প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেছে আইএমইডি। যেমন, নির্মাণসামগ্রীর মান বজায় রাখতে নিয়মিত ল্যাবরেটরির মাধ্যমে মান পরীক্ষা অব্যাহত রাখা, ঠিকাদারের কাজের গাফিলতি এবং অযৌক্তিক বিলম্বের জন্য পিপিআর ও পিপিএ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ড্রেজিং করা মাটি যথাযথ নীতিমালা মেনে ফেলা উচিত। সেক্ষেত্রে সরকারি খাসজমি চিহ্নিত করে সেগুলোর উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রকল্পটি নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ করতে জরুরিভিত্তিতে শূন্যপদে জনবল নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের সফল সমাপ্তির পর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিতে টেকসই বিনিয়োগ, সমস্যা উত্তরণে উদ্ভাবনী সমাধান ও সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা অপরিহার্য বলেও মনে করে আইএমইডি।
এমওএস/এএসএ/এমএফএ/এএসএম