করোনা: বৈশ্বিক সঙ্কটেও ভরসা চীনা মাস্কে
গত ১০ বছর ধরে চীনের কুয়ানঝু শহরে নিজ বাড়িতে ছোট্ট একটি কারখানায় ডায়াপার এবং শিশুদের অন্যান্য পণ্য-সামগ্রী তৈরি করেন লিউ। কিন্তু তার দশ বছরের এই কারখানার কর্মযজ্ঞে প্রথমবারের মতো পরিবর্তন এসেছে গত ফেব্রুয়ারিতে। দেশটিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয় মাস্কের।ব্যবসা বদলে লিউয়ের কারখানায় শুরু হয় মাস্ক উৎপাদন।
চীনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় ফুজিয়ান প্রদেশে লিউয়ের বাড়ির সেই কারখানায় কাজ করেন মাত্র ১০০ জন কর্মী। এখন তার এই কারখানায় দু'টি প্রোডাকশন লাইনে দিনে ২ লাখের বেশি মাস্ক উৎপাদিত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়িক চিন্তা-ভাবনা থেকেই লিউ মাস্ক তৈরির এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
পরে চীন সরকারের ভর্তুকি, শুল্ক হ্রাস, সুদমুক্ত ঋণ, কারখানা সম্প্রসারণের জন্য দ্রুতগতিতে প্রশাসনের অনুমোদন এবং শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াতে সরকারের সাহায্য আশীর্বাদ হিসেবে আসে। দ্রুতগতিতে কারখানায় উৎপাদিত হতে থাকে লাখ লাখ মাস্ক; যা স্বল্পমূল্যে চীনের বাজারের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি শুরু করেন লিউ।
তিনি বলেন, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার নানাভাবে সহায়তা করেছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রফতানিতে সরকার সহায়তা করেছে। চীনে বর্তমানে এ ধরনের হাজার হাজার কোম্পানি তাদের ব্যবসা পরিবর্তন করে প্রথমবারের মতো মাস্ক উৎপাদন শুরু করেছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন করে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে বিশ্ববাজারের মোট মাস্কের প্রায় ২০ শতাংশ সরবরাহ করতো চীন; যা দিনে প্রায় ২ কোটির সমান। চীনের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থা বলছে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে দিনে ১১ কোটি ৬০ লাখ মাস্ক উৎপাদন হয়েছে।
অস্ট্রিয়াভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ারিং জায়ান্ট কোম্পানি অ্যান্দ্রিৎজের চীন শাখার প্রেসিডেন্ট থমাস শিমিৎজ বলেন, বেইজিংয়ের এই তাৎপর্যপূর্ণ লাফ যুদ্ধকালীন নীতিমালা বদলের মতো। দেশব্যাপী মাস্ক তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বেইজিং শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছে; যা দেশটির উৎপাদনশীল ইঞ্জিনকে আরও গতিশীল করেছে।
তিনি বলেন, আমার কাছে এটাই চীনের বিশাল সুবিধা, এটাই বড় গতি। থমাস শিমিৎজ বলেন, যখন দৌড়ানোর দরকার, তখন মানুষ জেনে যায় কীভাবে দৌড়াতে হবে। আর এটা এমন একটি বিষয়; যা বিশ্বের অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলোতে পাওয়া যাবে না।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর চীনের তেল ও গ্যাসের প্রধান কোম্পানি সিনোপেক মাস্কের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল যেমন- পলিপ্রোপিলিন ও পলিভিনিল ক্লোরাইডের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। চলতি সপ্তাহে এই কোম্পানি বেইজিংয়ে নতুন করে দুটি প্রোডাকশন লাইনে মাস্কের ফেব্রিক উৎপাদন শুরু করেছে। যা দিনে চার টন ফেব্রিক উৎপাদনে সক্ষম। এই ফেব্রিকের মাধ্যমে দিনে অন্তত ৬০ লাখ সার্জিক্যাল মাস্ক এবং এন৯৫ শ্বাসযন্ত্র তৈরি করা হবে।
দেশটির স্থানীয় দৈনিক দ্য সিচুয়ান ডেইলি বলছে, চীনের নতুন স্টিলথ যুদ্ধবিমান জে-২০'র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চেংডু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ তাদের কোম্পানির কিছু অংশে উৎপাদন বদল করেছে। এই কোম্পানির অন্তত ২৫৮ জন ইঞ্জিনিয়ার এখন দ্রুত উৎপাদনশীল মাস্কের নকশা তৈরি করছেন।
চীনে এই মুহূর্তে আড়াই হাজারের বেশি কোম্পানি মাস্ক তৈরি করছে। এর মধ্যে আইফোন উৎপাদনকারী ফক্সকন এবং স্মার্টফোন প্রস্তুতকারী শাওমি এবং ওপপো রয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের যুদ্ধকালীন প্রচেষ্টা সর্বশেষ দেখা যায় গত শতাব্দির মাঝের দিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপে। কিন্তু বর্তমানে দ্রুতগতিতে এ ধরনের নীতিবদল চীন ছাড়া অন্য কোনও দেশ করতে পারবে কিনা সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে।
চীনে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও দেশটিতে এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। চীনে ৩ হাজার ১৬৯ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়া এই ভাইরাস এখন বিশ্বের ১২৪টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা প্রাদুর্ভাবকে বিশ্ব মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
চীনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও ভয়াবহ প্রকোপ শুরু হয়েছে এখন ইতালিতে। ইউরোপের এই দেশটি করোনা সামলাতে রীতিমতো হিমশিত খাচ্ছে; এমন পরিস্থিতিতে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে চীন। বেইজিং ইতোমধ্যে ইতালিতে এক হাজার ভেন্টিলেটর, ২০ লাখ মাস্ক, এক লাখ শ্বাসযন্ত্র, ২ লাখ সুরক্ষা স্যুটস ও ৫০ হাজার টেস্টিং কিট পাঠিয়েছে।
নিজ নিজ দেশে মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রীর ঘাটতি দেখা দেয়ায় ফ্রান্স এবং জার্মানি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইগি দি মাইও। পরে চীন ওই সব সামগ্রী ইতালিতে পাঠিয়ে দিতে চায় বলে জানান ওয়াং ই।
এসআইএস/জেআইএম