যেভাবে করোনা রোগীশূন্য উত্তর কোরিয়া
একজনও করোনা রোগী দেশে নেই বলে দাবি করেছে বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন কোরীয় উপদ্বীপের উত্তর কোরিয়া। দেশটির এমন দাবি ঘিরে বিশ্বজুড়ে সংশয় বাড়ছে। যদিও করোনা রোগী না পাওয়ার এই সফলতার জন্য সংক্রমণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা এবং দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়াকে কৃতিত্ব দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া।
কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়োজিত মার্কিন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ এক কমান্ডার বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার এই দাবি সত্য নয়। এই দাবিকে অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এদিকে, উত্তর কোরীয় এক বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, দেশটিতে হয়তো করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু এখনও ব্যাপক প্রাদুর্ভাব শুরু হয়নি।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, বিশ্বজুড়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে এবং মারা গেছেন ৫৩ হাজার ৬৯ জন।
উত্তর কোরিয়ার সেন্ট্রাল এমারজেন্সি অ্যান্টি-এপিডেমিকের পরিচালক পাক ইয়ং-সু শুক্রবার ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেছেন, আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত একজনও নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি।
তিনি বলেন, আমরা পূর্ব সতর্কতা এবং বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন পদক্ষেপ- যেমন দেশে যারা এসেছেন তাদের সবাইকে শনাক্ত করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো এবং সব ধরনের পণ্য-সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করেছি। পাশাপাশি স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথের সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছি।
এই দাবি কি সত্য হতে পারে?
দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল রবার্ট আবরামস বলেন, উত্তর কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের কোনও সংক্রমণ নেই; এই দাবিটি পুরোপুরি মিথ্যা।
সিএনএন এবং ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া স্বাক্ষাৎকারে মার্কিন এই কর্মকর্তা বলেছেন, আমার এখন পর্যন্ত যেসব গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছি; তার ভিত্তিতে বলতে পারি উত্তর কোরিয়ার দাবিটি মিথ্যা এবং অসম্ভব। তবে দেশটিতে কতজন করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন, সেব্যাপারে সঠিক কোনও তথ্য দিতে পারেননি এই মার্কিন কর্মকর্তা। এছাড়া গোয়েন্দা তথ্য কোথায় থেকে এসেছে সেটিও জানাননি তিনি।
উত্তর কোরিয়াবিষয়ক মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনকে নিউজের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ওলিভার হোথামও বলেছেন, উত্তর কোরিয়ায় করোনা সংক্রমণের ঘটনা থাকতে পারে। তিনি বলেন, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়ায় করোনা সংক্রমণের ঘটনা না থাকাটা একেবারেই অসম্ভব। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে দেশটির বৃহৎ সীমান্ত বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তারা এটাকে প্রতিরোধ করতে পারে এমন কোনও সম্ভাবনা আমি দেখছি না।
তবে দেশটিতে এখনও পুরোমাত্রার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়নি বলে জানান তিনি। ওলিভার বলেন, আসলে তারা অনেক আগেই পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি মনে করি, তারা পুরোমাত্রার প্রাদুর্ভাবকে আটকাতে পেরেছে।
এই সঙ্কট কীভাবে মোকাবিলা করছে উত্তর কোরিয়া?
ওই অঞ্চলের অনেক দেশ এই ভাইরাসটি মোকাবিলায় দেরীতে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করলেও উত্তর কোরিয়া খুব দ্রুত নড়েচড়ে বসেছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে এই ভাইরাস ধরা পড়ার পর জানুয়ারি মাসেই সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয় উত্তর কোরিয়া। পরে রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে শত শত বিদেশিকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। ওই সময় চীনে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।
এনকে নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ায় ১০ হাজারের বেশি মানুষকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এছাড়া কোয়ারেন্টাইনে আছেন আরও প্রায় ৫০০ জন।
উত্তর কোরীয়রা কি এই ভাইরাসের ব্যাপারে অবগত?
ওলিভার হোথাম বলেন, উত্তর কোরিয়ার অধিকাংশ মানুষই আসলে এই ভাইরাসের কারণে কী ঘটতে যাচ্ছে সেব্যাপারে অবগত। তিনি বলেন, প্রত্যেকদিন গণমাধ্যমে ব্যাপক খবর আসছে। দেশটির গণমাধ্যমে প্রত্যেকদিন পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপ এবং বিশ্ব পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা হচ্ছে।
কুকমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক ফিয়োদোর টার্টিস্কি বলেন, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করতে হবে সেটি জনগণকে জানানোর জন্য দেশটি এখন ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেমন?
বিশেষজ্ঞদের জবাব, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আপনি যেভাবে ভাবছেন, উত্তর কোরিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থা তার চেয়ে ভালো। ফিয়োদোর টার্টিস্কি বলেন, একই ধরনের জিডিপির কিছু দেশের চেয়ে উত্তর কোরিয়ার স্বাস্থ্যব্যস্থা অনেক অনেক ভালো।
তিনি বলন, তারা প্রচুর চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে; যদিও পশ্চিমা বিশ্বের চিকিৎসকদের তুলনায় তারা কম দক্ষতাসম্পন্ন। তারপরও তারা দেশের মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে সক্ষম।
তার এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে ওলিভার হোথাম বলেন, উত্তর কোরিয়া যে পরিমাণে চিকিৎসক আছেন, তারা মৌলিক অসুস্থতার চিকিৎসা দিতে পারেন। কিন্তু গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে যে ধরনের সরঞ্জাম প্রয়োজন সেগুলোর অপ্রতুলতা রয়েছে। তবে দেশটির আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতির পেছনে অবশ্য নিষেধাজ্ঞাও কাজ করছে।
উত্তর কোরিয়া কেন সংক্রমণ লুকানোর চেষ্টা করবে?
যদি এই মুহূর্তে স্বীকার করে যে, তাদের করোনা সংক্রমিত রোগী আছেন; তাহলে সেটি দেশটির জন্য পরাজয়ের একটি লক্ষণ হতে পারে। হোথাম বলেন, উত্তর কোরিয়ার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করার মতো প্রচুর ঘটনা আছে। এছাড়া তারা কতটা ভালো কাজ করছে সেটি নিয়েও দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচারণা আছে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, তারা যদি এখন স্বীকার করে যে করোনা সংক্রমণ আছে; তাহলে সেটি তাদের পরাজয়। এছাড়া এটি করলে দেশে আতঙ্ক তৈরি হবে এবং লোকজন বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবে। আর ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যদি বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে কিংবা চলাচল করে তাহলে তা অস্থিরতা তৈরি করবে, এমনকি সংক্রমণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
এসআইএস/জেআইএম