ভারতে করোনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে তাবলিগ জামাতের দায় কতটা?
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গত মাসে তাবলিগ জামাতের বিতর্কিত ধর্মীয় সমাবেশটি একাই এ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। ভারতে মোট যতগুলো করোনা পজিটিভ কেস শনাক্ত হয়েছে; তার ৩০ শতাংশই তাবলীগের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এ জন্য গোটা দেশে অন্তত বাইশ হাজার তাবলীগ সদস্য ও তাদের 'কন্ট্যাক্ট'দের কোয়ারেন্টিনে রাখতে হয়েছে।
তবে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ আবার বলছেন, দেশে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য এভাবে তাবলীগকে ঢালাওভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ তারা ওই সময় সমাবেশটি করে দেশের সে সময় জারি থাকা কোনও আইন ভাঙেনি।
আর তা ছাড়া এখানে তাদের গাফিলতি থেকে থাকলে সরকারের ব্যর্থতাও মোটেই কম নয় বলেও তারা মনে করছেন। ভারত সরকার বলছে, ৫ এপ্রিল বিকেলে দেখা গেছে, ভারতে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের শনাক্তকরণের হার দ্বিগুণ হয়েছে মাত্র ৪.১ দিনে। অথচ তার আগে এই হার দ্বিগুণ হতে সময় লাগছিল ৭.৪ দিন।
প্রায় সাড়ে সাতদিন থেকে কমে এসে এই যে মাত্র চারদিনের মাথায় রোগীর সংখ্যা ভারতে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে - এর জন্য ভারত সরকার একটি নির্দিষ্ট ইভেন্টকেই দায়ী করছে, আর সেটি হল দিল্লির মারকাজ নিজামুদ্দিনে গত মাসে তাবলীগ জামাতের সমাবেশ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লাভ আগরওয়াল বলছেন, রোববার পর্যন্ত সারা দেশে যে সোয়া তিন হাজারের মতো করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছিল, তার মধ্যে ১০২৩জনই কোনও না কোনওভাবে তাবলিগ জামাতের সাথে সম্পর্কিত।
সারা দেশের মোট ১৭টি রাজ্য থেকে এই ধরনের রোগীদের পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কেবল থেকে কাশ্মীর, গুজরাট থেকে আসাম - এমনকি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জও বাদ নেই।
ফলে আমরা বলতে পারি, গোটা দেশের ৩০% কেসই এই এমন একটি ঘটনার সাথে সম্পর্কিত, যেটি আমরা বুঝতেও পারিনি বা সামলাতে পারিনি। তাবলিগের ক্ষেত্রে যেটা আরও বড় সমস্যা হয়েছে তা হল জামাতফেরত হাজার হাজার মুসল্লি ট্রেনে, বাসে বা প্লেনে করে ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং রাস্তায় বা বাড়িতে ফিরেও তারা বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন।
এদের মধ্যে বেশ কয়েকশো বিদেশি নাগরিকও ছিলেন, তারাও অনেকেই ভারতে 'চিল্লা' বা ধর্মীয় প্রচারে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ফলে তাবলীগের সঙ্গে করোনাভাইরাসের যোগ সূত্রের সন্ধানে ভারতে যে মাপের 'ম্যানহান্ট' বা 'কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং' করতে হয়েছে তা প্রায় নজিরবিহীন।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা পুণ্যা শ্রীবাস্তব জানান, সারা দেশে বিরাট এক অভিযান চালিয়ে মোট বাইশ হাজার তাবলীগ কর্মী ও তাদের কন্ট্যাক্টদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এই সংখ্যা অবশ্যই আরও বাড়বে; তবে আমরা আশা করছি এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সফলভাবে লকডাউন প্রয়োগ করে আমরা কোভিড ছড়ানোর শৃঙ্খলকে ভাঙতে পারব।
তবে ভারতের বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ এবং হায়দরাবাদের নালসার ইউনিভার্সিটি অব ল-র উপাচার্য ড. ফায়জান মুস্তাফা মনে করেন, ভারতে ভয়ঙ্কর গতিতে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য এরকম একতরফাভাবে তাবলীগ জামাতকে অভিযুক্ত করা ঠিক নয়।
কারণ তার গবেষণা বলছে, তাবলীগ দেশের কোনও আইন ভাঙেনি। তিনি আরও মনে করেন, যে কোনও কথিত অপরাধের তদন্তে ঘটনার তারিখ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এই তাবলীগের ঘটনাও তার ব্যতিক্রম নয়। ড. মুস্তাফার কথায়, তারিখগুলো ভাল করে খেয়াল করুন। ১৩ মার্চ ভারতে যখন করোনাভাইরাস পজিটিভ কেস ৮১টি, তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আগরওয়াল জানাচ্ছেন, দেশে কোনও হেলথ ইমার্জেন্সি তৈরি হয়নি।
ওই একই দিনে দিল্লি সরকার একটি নির্দেশ জারি করে রাজধানীতে সেমিনার ও কনফারেন্স নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে সেখানেও ধর্মীয় সমাবেশের কোনও উল্লেখ ছিল না। ফলে ১৩ মার্চেও কিন্তু দিল্লিতে ধর্মীয় সমাবেশের অনুমতি ছিল। আর তাবলীগ তাদের জামাতের আয়োজন করেছিল ১৩ থেকে ১৫ মার্চ।
অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দির, কিংবা হিন্দুদের তিরুপতি, সিদ্ধিবিনায়ক, বৈষ্ণোদেবী বা কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের মতো যে সব ধর্মীয় স্থানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। সেগুলোও যে কোনটি ১৬ মার্চ, কোনটি ১৮ বা ২০ শে মার্চ পর্যন্ত খোলা ছিল সেটাও তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
ফলে তাবলীগ জামাতের দিক থেকে গাফিলতি হয়ে থাকলেও সেটা 'অনেস্ট মিস্টেক' বা অনিচ্ছাকৃত একটি ভুল বলেই ফায়জান মুস্তাফার অভিমত। যে ঘটনায় দিল্লি সরকার বা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তাদের দায় এড়াতে পারে না। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/এমএস