করোনাকালে খাদ্য সংকট এড়ানো সম্ভব: ইকোনমিস্ট
অডিও শুনুন
গত জানুয়ারিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সবধরনের পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করে দেয় চীন। এতে সাধারণ পর্যটকেরা শুধু অসন্তুষ্ট হলেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল নিউজিল্যান্ডের বাণিজ্যমন্ত্রী ডেভিড পার্কারের কপালে। কারণ, চীনগামী বিমানগুলোতে শুধু পর্যটকই নয়, যেত বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্যও। চীনই তাদের খাদ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা।
চীনের নির্দেশনার কারণে বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে ফ্লাইট বাতিলের হিড়িক পড়ে যায়। ফলে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে দেখা দেয় বড় সংকট। এই বিপদ কাটাতে সে সময় এয়ার নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করে কিউই সরকার- যারা বিমানের যাত্রীআসন খালি থাকলেও ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য নিয়ে চীন, সিঙ্গাপুর ও আমেরিকার রুটে যাতায়াত করবে, তাদের ঋণ দেয়া হবে। একই প্রস্তাব দেয়া হয় মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক এয়ারলাইনগুলোকেও। ডেভিড পার্কারের ভাষায়, ‘সেখানে সংযোগ বজায় রাখায় পারস্পরিক সুবিধা ছিল।’
আজকের আধুনিক বিশ্বে কৃষি শিল্পের সব জটিলতাই এই ‘সংযোগ’কে ঘিরে। পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের চার-পঞ্চমাংশের মুখে খাবারের সংস্থান হয় আমদানির মাধ্যমে। গত বছর খাদ্য আমদানিতে যে দেড় লাখ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে, ২০০০ সালের তুলনায় তা প্রায় তিনগুণ বেশি। প্রতিনিয়ত অসংখ্য বিমান, জাহাজ, লরিতে করে খাদ্যপণ্য আনা-নেয়া হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এই জটিলতা সত্ত্বেও করোনা মহামারির মধ্যে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা এখনও বেশ মসৃণ গতিতেই চলছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে দ্রুত উৎস বদল ও সরবরাহ ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে। এ বছর বেশিরভাগ কাঁচামালেরই দাম কমতে দেখা গেছে।
কোনও ব্যবস্থা যত বেশি জটিল, সেটিতে তত বেশি ফাঁক থাকার সম্ভবনা থাকে। এবারের মহামারিতেও বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার খাদগুলো নতুন করে ধরা পড়ছে। তবে এসব ফাঁক-ফোকর নয়, বরং এরচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- মহামারির কারণে অন্তত ১০০ কোটি মানুষের আয় কমেছে নাহয় বন্ধ হয়ে গেছে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে, চলতি বছর বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২৬ কোটি থেকে দ্বিগুণ বেড়ে যেতে পারে।
উন্নত দেশগুলোও এই ঝুঁকিমুক্ত নয়। আমেরিকাতেই খাবারের জন্য মানুষের এক কিলোমিটারের বেশি লম্বা লাইন দেখা গেছে। এই অবস্থায় খাদ্য শৃঙ্খলে সামান্য পরিবর্তন পুরো ব্যবস্থাকেই হুমকিতে ফেলতে পারে, যাতে খাবারে দাম বেড়ে যাওয়াসহ ভয়াবহ দুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক খাদ্য ব্যবস্থা
খাদ্য উৎপাদকরা দেশীয় হলেও এ শিল্পে বাকি অংশের বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক। উৎপাদনের জন্য কৃষকের প্রয়োজনীয় বীজ, সার, যন্ত্রপাতির বেশিরভাগই আসে বিদেশ থেকে। এক্ষেত্রে মধ্যসত্ত্বভোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্যের উৎস নির্ধারণ, মজুতকরণ ও পরিবহনের কাজগুলো করে থাকে। সংকট দেখা দিলে তারাই দ্রুত উৎস বা পরিবহনের রাস্তা পরিবর্তন করে খাদ্য ব্যবস্থা সচল রাখায় বড় ভূমিকা রাখে।
প্রক্রিয়াজাতকরণে দীর্ঘ পথ
খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের দীর্ঘসূত্রিতা এই ব্যবস্থাকে আর জটিল করে তুলেছে। একেক জায়গা থেকে একেকটি যন্ত্রাংশ এনে যেমন পুরো গাড়ি তৈরি হয়, খাদ্য ব্যবস্থাতেও অনেক জায়গায় একই পদ্ধতি রয়েছে। যেমন- ইউক্রেনের গম আটায় পরিণত হয় তুরস্কের কারখানায়, সেটি হয়তো আবার নুডলসে পরিণত হচ্ছে চীনে গিয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ২০ বছরে বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থা অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। এ কারণে করোনাভাইরাস মহামারি ২০০৭-০৮ সালের মতো আবারও ভয়াবহ খাদ্য সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এক যুগ আগের ওই সংকটে বিশ্বের অন্তত সাড়ে সাত কোটি মানুষ ক্ষুধাপীড়িত হয়ে পড়েছিল, খাবারের জন্য বিভিন্ন দেশে দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল, এমনকি খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল সরকারগুলোও। এই সংকট থেকেই সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের দানা বাঁধতে শুরু করেছিল।
বর্তমান বিশ্ব আগের চেয়েও অনেক বেশি আমদানিনির্ভর, তবে এর সঙ্গে খাদ্য ব্যবস্থার ভিত্তিও আগের তুলনায় মজবুত হয়েছে। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপে গম উৎপাদন হয়েছিল খুবই কম, আমেরিকায় ভূট্টা উৎপাদনও সুবিধার ছিল না, খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১৯৭৩ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। তেলেরও দাম ছিল আকাশছোঁয়া, যার ফলে খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ হয়ে উঠেছিল বেশ ব্যয়বহুল।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অতটা দুর্বল নয়। বর্তমানে খাদ্যশস্যের মজুত রয়েছে ওই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ, পণ্য পরিবহনে খরচ হচ্ছে ২০ গুণ কম, অপরিশোধিত তেলের দামও প্রতি ব্যারেল মাত্র ৩০ ডলারের মতো। এর ফলে শস্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ থাকছে অনেকটা তলানির দিকেই। গত এক যুগে আমদানিকারক দেশের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, সেই হারে বেড়েছে রপ্তানিকারক দেশও। ফলে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা আগের চেয়ে স্থিতিস্থাপক অবস্থায় রয়েছে।
রয়েছে চ্যালেঞ্জও
আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা মানেই যে কোনও চ্যালেঞ্জ নেই, তা নয়। গত মার্চে লকডাউন ও এর প্রভাবে ব্যাপকহারে গৃহস্থালী পণ্য মজুত করা শুরু হয়েছিল। কিছু দেশে টিনজাত খাদ্যপণ্যের বিক্রি বেড়েছে অন্তত সাতগুণ। অনেক জায়গায়তেই সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে।
তবে সবকিছুরই বিকল্প রয়েছে। এপ্রিলে যখন ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, কেয়ারফোর নামে একটি ফরাসি প্রতিষ্ঠান ঠিকই পাকিস্তান ও ভিয়েতমান থেকে আমদানির নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে।
অভ্যাসে পরিবর্তন
মহামারি আর লকডাউনের মধ্যেও খাদ্য চাহিদা অনেকটাই স্বাভাবিক রয়েছে। তবে পরিবর্তন এসেছে অভ্যাসে। আগে রেস্টুরেন্ট-ক্যাফেতে মানুষ যে ধরনের খাবার খেত, এখন বাসায় বন্দী অবস্থায় অনেকেই সে ধরনের খাবার খাবেন না।
আছে পরিমাণগত পার্থক্যও। রেস্টুরেন্টে ব্যবহারের জন্য একদিনে হয়তো ১৬ কেজির এক বস্তা আটা বিক্রি হতো, ঘরোয়া ব্যবহারের জন্য কেউ এত পরিমাণে পণ্য কিনবে না। সেক্ষেত্রে তারা ছোট ছোট প্যাকেট নিতেই বেশি আগ্রহী। আর পণ্যগুলো ছোট প্যাকেটজাত করতেও আরও বেশি সময় ও শ্রম খরচ হয়।
এসব জটিলতার কারণে খাদ্য উৎপাদকরাই মূলত বিপাকে পড়েছেন। ফরাসি জেলেরা জানিয়েছেন, তারা শিকার করা মাছের দুই-তৃতীয়াংশই আবারও জলাশয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। অ্যাভোক্যাডো নিয়ে সমস্যায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এক খামারি জানিয়েছেন, তিনি গবাদি পশুগুলোকেই গরুর দুধ খাওয়াচ্ছেন।
সাধারণত পচনযোগ্য ফলমূল, তরিতরকারি পরিবহনেই দীর্ঘসূত্রিতায় বেশি সমস্যা হয়। থাইল্যান্ডের ড্রাগন ফ্রুট চীনে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর পাইকারি বিক্রি কমে গেছে অন্তত ৮৫ শতাংশ।
ছোট নিষেধাজ্ঞায় বড় প্রভাব
বাজার যখন ঝুঁকিতে থাকে, তখন ছোট একটি নিষেধাজ্ঞাতেই খাদ্য ব্যবস্থায় অনেক বড় সংকট তৈরি হতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ওলাম ইন্টারন্যাশনালের এক কর্মকর্তা জানান, বিশ্বের মাত্র চার-পাঁচটি দেশ নিজেদের চাহিদার বেশি চাল উৎপাদন করে। এ কারণে সম্প্রতি ভিয়েতনাম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বিশ্ববাজারে এর দাম বেড়ে গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটির ড. জোনাথন লাসা বলেন, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্রেতারা মজুত করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এতে ভয়াবহ এক চক্র সৃষ্টি হতে পারে। আমদানিনির্ভর দেশগুলো ‘কৌশলগত’ কারণে সাধারণত তিন মাস সরবরাহযোগ্য শস্যের মজুদ রাখে। তারা এখন আরও একমাসের মজুত করতে পারে।
সংকট মোকাবিলা সম্ভব
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে মজুতকরণের প্রবণতা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তবে বৈশ্বিক সমন্বয়ের মাধ্যমে এই বিপদ সীমার মধ্যেই রাখা সম্ভব।
গত মাসে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২২টি সদস্য দেশ বাণিজ্য চালু রাখার অঙ্গীকার করেছে। এই ২২টি দেশই বিশ্বের ৬৩ শতাংশ কৃষিপণ্য রপ্তানি করে থাকে। এছাড়া, কৌশলগত মজুতের বিষয়ে দেশগুলো আরও স্বচ্ছ হলে দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমতে পারে। সহযোগিতা হতে পারে আঞ্চলিক পর্যায়েও। স্থানীয় সুপারমার্কেটগুলো আন্তঃবাণিজ্য প্ল্যাটফর্ম চালু করতে পারে, যেখানে কারও কোনও পণ্যের সংকট দেখা দিলে অন্যদের সঙ্গে সেগুলো বিনিময় করা যাবে। এ ধরনের আন্তঃসহযোগিতা ও সংযোগ বজায় রাখলে করোনাভাইরাস মহমারিতে খাদ্য সংকট প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কেএএ/জেআইএম