সেনা আধিপত্যে বিদায় ঘণ্টা বাজছে ইমরান খানের?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭:৩৪ পিএম, ১০ জুন ২০২০

অনানুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ দেশটির সেনা জেনারেলদের হাতে ফিরছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশটির সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করায় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে শুরুর দিকে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও বর্তমানে তাতে ফাটল ধরেছে। আর এটি স্পষ্ট হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান পরিবহন সংস্থা, বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব এখন সেনাবাহিনীর হাতে। এসব প্রতিষ্ঠানই দেশটিতে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে গত দুই মাসের মধ্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

অর্থনৈতিক টানাপড়েন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের দুর্নীতির তদন্তের কারণে দেশটিতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ার মাঝে বাড়ছে সেনা আধিপত্য। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসা বিশ্লেষকরা সেনাবাহিনীর এ ধরনের সমর্থন ইমরান খানের দলের জন্যও শঙ্কার কারণ হতে পারে জানাচ্ছেন। দেশটির পার্লামেন্টে ইমরান খানের রাজনৈতিক দলের ৪৬ শতাংশ আসন রয়েছে; ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশটির ছোট ছোট কিছু দলের সঙ্গেও জোট বাঁধতে হয়েছে খানকে।

তবে কিছু দিক থেকে দেখা হলে এটাকে নতুন কিছুই মনে হবে না। পাকিস্তানে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয় দেশটির সেনাবাহিনীকে। স্বাধীনতার সাত দশকের ইতিহাসের প্রায় অধিকাংশ সময়ই সরাসরি পাকিস্তান শাসন করেছে সেনাবাহিনী। ২০১৮ সালে নয়া পাকিস্তান গড়ার অঙ্গীকার করে ইমরান খান ক্ষমতায় এলেও এখনও তা অধরাই রয়ে গেছে।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে সাবেক এবং বর্তমান সেনা কর্মকর্তাদের ক্রমবর্ধমান নিয়োগ বেসামরিক নীতি-নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের যে জায়গা ছিল সেগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ ফেলো উজাইর ইউনুস। তিনি বলেন, প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও গোপনীয় ভূমিকা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পাকিস্তানের অনেকেই দেখেছেন দেশটির করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় সরকারকে ইউনিফর্ম পরিহিত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে সহায়তা করছেন। এছাড়া ইমরান খানের বর্তমানে যোগাযোগ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দেশটির সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল অসিম সালিম বাজওয়া। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের দেখাশোনার দায়িত্ব সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার।

পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মুশাররফের মন্ত্রিসভায় ছিলেন এমন অন্তত ১২ জন সদস্য ঠাই পেয়েছেন ইমরান খানের সরকারে; যারা সেনাবাহিনীর অনুগত হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছেন দেশটির বর্তমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ইজাজ শাহ ও ইমরান খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আব্দুল হাফিজ শেখ। এছাড়াও আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে দেশটির সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা রয়েছেন।

২০১৭ সালে ইমরান খানের বিরুদ্ধে সেনা ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠলে তা নাকচ করে দেন এই পাক প্রধানমন্ত্রী। সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসার নকশা করছেন বলে সেই সময় অভিযোগ উঠে। গত বছর স্থানীয় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী আমার পাশে রয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশায় আবারও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ করোনা আক্রান্ত পাকিস্তানে। দেশটির এক লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন; মারা গেছেন প্রায় ২ হাজার ২০০ জন।

গত ৬৮ বছরের মধ্যে এবারই পাকিস্তানের অর্থনীতির রেকর্ড সংকোচন ঘটতে যাচ্ছে। চলতি মাসে আর্থিক বছর শেষে দেশটির অর্থনীতি দেড় শতাংশ সংকুচিত হতে পারে বলে পূর্বাভাষ দিয়েছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশটির অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে ঋণের গভীর বেড়াজালে আটকা পড়ছে। গত এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে থেকে জরুরি ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা নেয় পাকিস্তান।

দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা বেশ জোরালোভাবে প্রকাশ হতে শুরু করে গত মার্চে; যখন দেশটিতে করোনা মহামারির বিস্তার ঘটতে শুরু করে। মার্চের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান করোনা মহামারিতে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানোর পরদিনই দেশটির সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লকডাউন ঘোষণা করেন।

এছাড়া প্রত্যেকদিনের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ের নেতৃত্বে থাকে সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখা। এমনকি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখার লোগো এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার নামও সংযুক্ত থাকে।

গত ২৪ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলে এক সাংবাদিক দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে প্রশ্ন করেন আসলে এই ব্রিফিংয়ের নেতৃত্বে কারা? সেনাবাহিনীর কথা উল্লেখ না করলেও ওই সাংবাদিকের এই প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হন ইমরান খান; হুমকি দেন সংবাদ সম্মেলন থেকে চলে যাওয়ার।

গত মে মাসে দেশটির সরকারি মালিকানাধীন একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। তখন সরকারি এই বিমান সংস্থায় সামরিক নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে বিমান পরিবহন মন্ত্রী গোলাম সারওয়ার খান সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গান। তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়োগ দেয়া দোষের কিছু নয়।

মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক বিষয় নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লষণকারী সংস্থা নিউইয়র্কের বিজিয়ার কনসাল্টিংয়ের প্রেসিডেন্ট আরিফ রফিকের মতে, ইমরান খানের আধিপত্য যত কমবে, সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ততই বাড়বে। সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ যত বাড়বে, ততই তারা ক্ষমতার অন্দরে জেঁকে বসবেন।

তিনি বলেন, ‘ইমরানের ওপর চাপ ক্রমেই আরও বাড়বে। কারণ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও লকডাউনের ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি আরও বেশি সঙ্কটের মধ্যে পড়তে চলেছে।’

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ সহযোগী মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের জ্যেষ্ঠ পদগুলোতে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তখন বেসামরিক কর্মকর্তারা সাড়া না দিলে সেখানে সমস্যা তৈরি হয়।

তিনি বলেন, আর গণতন্ত্রের ঝুঁকি এখানেই। যদি অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা বর্তমানে বসদের চেয়ে সাবেক বসদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হন তাহলে গণতন্ত্র সঠিক পথে চলতে পারে না।

সূত্র: ব্লুমবার্গ।

এসআইএস/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।