লকডাউন সত্ত্বেও পেরুর অবস্থা ভয়াবহ হলো কী করে?
অডিও শুনুন
লাতিন আমেরিকায় সবার আগে এবং সবচেয়ে কড়া লকডাউন দেয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম পেরু। তারপরও বর্তমানে আক্রান্তের হিসাবে বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে তারা। দেশটির প্রেসিডেন্ট খোদ স্বীকার করেছেন, তাদের দেয়া লকডাউন ঠিকমতো কাজ করেনি। কিন্তু কেন? পেরুর সমস্যাটা ছিল কোথায়?
সীমান্ত বন্ধ ও কারফিউ
যুক্তরাজ্যসহ বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশের আগেই গত ১৬ মার্চ লকডাউন জারি করে পেরু। বন্ধ করে দেয়া হয় দেশটির সীমান্ত, জারি করা হয় কারফিউ, অত্যাবশ্যক নিত্যপণ্য কেনা ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে পারেনি জনগণ। সম্প্রতি পেরুতে লকডাউনের সময়সীমা বাড়িয়ে জুনের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী লকডাউন চলছে সেখানে।
এরপরও পেরুতে আক্রান্ত-মৃত্যুর পাহাড় বাড়ছে প্রতিদিনই। বিশ্বের মধ্য অন্যতম সর্বোচ্চ মৃত্যুর হার সেখানে। সরকারি হিসাবে, দেশটিতে এ পর্যন্ত সাড়ে আট হাজার মানুষ করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন, আক্রান্ত অন্তত ২ লাখ ৭২ হাজার। যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের বাকি সব দেশের চেয়ে পেরুতে করোনায় আক্রান্ত বেশি।
প্রতি হাজারে মাত্র ছয়জনের করোনা টেস্ট করালেও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের তুলনায় বেশি টেস্ট করেছে পেরু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় দেশটির স্বাস্থ্য খাত প্রস্তুত ছিল না, যার কারণে অতিরিক্ত মৃত্যু ও সংক্রমণ দেখতে হচ্ছে। তবে এটির পাশাপাশি সেখানকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক আরও কয়েকটি কারণ দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
১. বাজার
সরকারি হিসাবে, পেরুর ৪০ শতাংশ জনগণের বাড়িতে খাবার সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর নেই। ফলে খাবার কিনতে তাদের বারবার বাজারে যাওয়া লাগে। পেরুর প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভিজকারার মতে, দেশটিতে করোনা বিস্তারের প্রধান উৎস এসব কাঁচাবাজার।
উদাহরণস্বরূপ, পেরুর রাজধানী লিমার লা ভিক্টোরিয়া ফল বাজারের প্রায় ৮৬ শতাংশ বিক্রেতা মে মাসে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘আমাদের ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ বিক্রেতা আক্রান্ত বাজার রয়েছে। আপনি খাবার কিনতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন, বাসায় সেই ভাইরাস নিয়ে ফিরলেন এবং সেখান থেকে পুরো পুরিবারে এটি ছড়িয়ে পড়ল।’
পেরুর বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশটিতে বাজার খোলা রাখার সময় সীমিত করে দেয়ায় ভিড় আরও বেড়েছে। এর ফলে সংক্রমণও ছড়িয়েছে দ্রুত। দেশটির সরকার এখন করোনা মোকাবিলা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনার কথা ভাবছে।
২. অনানুষ্ঠানিক কাজ
পেরুর প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মজীবী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাজের ধরন অনিশ্চিত এবং অনেক সময় এতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও সম্ভব হয় না।
এ ধরনের কর্মীদের গণপরিবহনে যাতায়াত এবং অনেক সময় ভিড়ের মধ্যেই পণ্য বিক্রি করতে হয়। ফলে তাদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস।
৩. ব্যাংক
পেরুর ব্যাংকগুলোকে করোনা সংক্রমণের অন্যতম উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১২ শতাংশ করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের সহায়তার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে দেশটির সরকার। এ উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও সমস্যা বেঁধেছে এই অর্থ পৌঁছানো নিয়ে।
দেশটির মাত্র ৩৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ফলে ডিজিটাল পেমেন্ট একপ্রকার অসম্ভব। একারণে বহু মানুষকে প্রণোদনার অর্থ নিতে স্বশরীরে ব্যাংকে যেতে হচ্ছে। ভিড় নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যাংকের কর্মঘণ্টা বাড়ালেও তাতে কমেনি সংক্রমণের হার।
৪. সামাজিক দূরত্ব
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, পেরুর ১১ দশমিক ৮ শতাংশ দরিদ্র মানুষ ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাস করে। এসব জায়গায় সামাজিক দূরত্ব রাখা অনেকটাই অসম্ভব। এর কারণেও দেশটিতে দ্রুত ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী করোনা।
সূত্র: বিবিসি
কেএএ/এমএস