স্কুল বন্ধে সুফলের চেয়ে ঝুঁকি বেশি: ইকোনমিস্ট
অডিও শুনুন
করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গেছে, তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের মানসিক বিকাশ। গত এপ্রিলে ব্যাপক হারে ভাইরাস সংক্রমণের মুখে স্কুল বন্ধ করে দেয়ায় গৃহবন্দি হয়ে পড়ে বিশ্বের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরে ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে ফের স্কুল খোলায় শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। তবে অন্য স্থানগুলোতে এ উন্নয়নের গতি অত্যন্ত ধীর।
লস অ্যাঞ্জেলস-সান দিয়েগোসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঞ্চল নতুন শিক্ষাবর্ষে শুধু অনলাইনেই ক্লাস নেয়ার পরিকল্পনা করছে। কেনিয়া সরকার চলতি শিক্ষাবর্ষের বাকি অংশে আর স্কুল না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত তিনি শিশুদের স্কুলে ফেরাবেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্যাসিনো খুলেলেও এখনও বন্ধ বেশিরভাগ স্কুল।
অনেক মা-বাবাই সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। স্কুল অনেক বড় এবং জনাকীর্ণ জায়গা। তাছাড়া শিশুরা সামাজিক দূরত্বের বিষয়েও অতটা সচেতন নয়। তারপরও, স্কুল বন্ধ রাখায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
শিশুদের ঝুঁকি কম
গবেষণায় দেখা গেছে, নভেল করোনাভাইরাস শিশুদের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ। অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সীদের এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় অর্ধেক কম। যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান অনুসারে, ৭০ থেকে ৭৯ বছর বয়সীদের তুলনায় ১০ বছরের কম বয়সীদের করোনায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা অন্তত এক হাজার গুণ কম।
শিশুদের মাধ্যমে অন্যদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনাও কম বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুইডেনে প্রাইমারি ও নার্সারি স্কুলগুলো কখনোই বন্ধ হয়নি, তারপরও সেগুলোতে কর্মরতরা অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতদের তুলনায় আক্রান্ত হয়েছেন অনেক কম। যদিও, ইসরায়েলের একটি স্কুলে ১৫০ শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর এসেছে, তবে সতর্কতা মেনে চললে এ ধরনের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
স্কুল বন্ধে ক্ষতি বেশি
স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের অভ্যাস কমে যাচ্ছে। জুম ভিডিওকল স্কুলের সরাসরি পাঠদানের তুলনায় খুবই নিম্নমানের একটি বিকল্প। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনেকেরই উপযুক্ত ইন্টারনেট সুবিধার অভাব রয়েছে, অনেকের পিতামাতাও যথেষ্ট শিক্ষিত নন। ফলে অন্যদের তুলনায় তারা অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে।
শিশুদের রাখার মতো নিরাপদ জায়গা না পাওয়ায় কাজে যোগ দিতে পারছেন না অনেক বাবা-মা। বিশেষ করে, এতে বেশি সমস্যায় পড়ছেন নারীরা। ফলে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন তারাও। এছাড়া, স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের নির্যাতন, অপুষ্টি ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতিরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দরিদ্র দেশে সমস্যা বেশি
ধনী দেশগুলোতে স্কুল বন্ধে সমস্যা হলেও দরিদ্র দেশগুলোতে এর ফলাফল ভয়াবহ। ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে বিশ্বের অন্তত ৪৬ কোটি ৫০ লাখ শিশু অনলাইনে ক্লাস করতে পারবে না। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক পরিবার এতটাই সমস্যায় পড়েছে যে, তারা শিশুদের পড়াশোনা বাদ দিতে নাহয় বিয়ে করে নিতে বলছে। স্কুল যত বেশিদিন বন্ধ থাকবে, তত বেশি মানুষ এমন সিদ্ধান্ত নিতে থাকবে। সেভ দ্যা চিলড্রেন বলছে, করোনা সংকটে প্রায় এক কোটি শিশু স্কুলছাড়া হবে, যার বেশিরভাগই মেয়েশিশু।
দরিদ্র দেশগুলোতে মাত্র চার ভাগের এক ভাগ স্কুলে হাতধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাবান-পানির সুবিধা রয়েছে। স্কুলেই অনেক সময় শিশুদের হাম-টিটেনাসের মতো রোগের টিকা দেয়া হয়। ফলে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা এসব রোগের সামনে আরও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
সরকারি উদ্যোগ
স্কুল বন্ধের ভয়াবহ ফলাফল রোধে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো চালু করতে হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্কুল খোলার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে তা অবশ্যই বাজে পরিকল্পনা হবে, এমন ধারণাও ঠিক নয়।
অনেক দেশেই শিক্ষক সমিতিগুলো স্কুল খোলায় বাধা দিচ্ছে। তারা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ দেখালেও শিশুদের ও শিক্ষকদের আগ্রহের বিষয় কিন্তু এক নয়- বিশেষ করে, কাজ না করেও বেতন পেলে।
ফ্রান্স, ডেনমার্ক, চীন, নিউজিল্যান্ডের মতো যেসব দেশ ফের স্কুল চালু করেছে, তারা সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর যথাযথ পরামর্শও দিচ্ছে। তারা অরক্ষিত শিক্ষকদের বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়েছে। স্কুলের করিডোর, গেট, ডাইনিং হলে ভিড় কমাতে সময়সূচি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাস্ক পরায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। এসব দেশে স্কুলভিত্তিক করোনা টেস্টের হার বাড়ানো হয়েছে।
ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমিয়ে হলেও স্কুল চালু করা হয়েছে অনেক জায়গায়। এতে অনেক শিক্ষার্থীই স্কুলে আগের চেয়ে কম সময় কাটাতে পারছে। তবে সেটি একেবারে না যাওয়ার চেয়ে অন্তত ভালো।
সবার সহযোগিতা
করোনা সংকট কাটিয়ে বিশ্বের স্কুলগুলো ফের চালু করা মোটেও কমখরুচে হবে না। শত শত কোটি বোতল হ্যান্ডস্যানিটাইজারের পাশাপাশি স্কুল পরিচালনাতেও সতর্ক হতে হবে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক শিডিউল ও সহযোগিতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এসব কাজে জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ হবে ঠিকই, তবে বুঝতে হবে, অনেক ট্যাক্সদাতাই কারও না কারও বাবা-মা। খরচ মেটাতে ধনী দেশগুলোকে দরিদ্র দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, খরচ যতই হোক না কেন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অজ্ঞতার হাত থেকে রক্ষার সামনে কিছুই নয়।
(দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত)
কেএএ/