মানবতাবিরোধী অপরাধ: তিনজনের কোন অপরাধে কী দণ্ড

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে মৌলভীবাজারের বড়লেখার আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুলসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুজন হলেন- মো. আব্দুল মতিন (পলাতক) ও আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই। এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ মে) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনাল গঠন করার পর এটি হলো ৪৫তম রায়। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও কে এম হাফিজুল আলম।
রায়ে ২৪০ পৃষ্ঠার মধ্যে সারসংক্ষেপ অংশ পাঠ করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রায় পড়া শুরু করেন বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম। এরপর রায় পড়েন বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার এবং সবশেষ দণ্ডসহ মূল রায় ঘোষণা করে বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম।
পলাতক আসামি আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও তার ভাই আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে ২ এবং ৫ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, আর ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগের প্রতিটিতে আলাদাভাবে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। অপর আসামি আব্দুল আজিজ ওরফে মনাইয়ের বিরুদ্ধে ১ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং ৪ নম্বর অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ে সন্তুষ্ট জানিয়ে প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি বলেন, এই রায়ে আমি একজন নারী হিসেবে বীরাঙ্গনাদের সম্মান জানাচ্ছি, যারা এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে আসতে পেরেছেন। এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।
আসামি আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও মতিনের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, সব নথিপত্র এবং সহমুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময় বলেছেন- এই আসামিরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কিন্তু একজন ব্যক্তির প্ররোচনায় তদন্ত সংস্থা তাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো।
অপরদিকে আব্দুল মান্নার ওরফে মনাইয়ের আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
প্রথম অভিযোগে আসামি আব্দুল মান্নান মনাইকে মৃত্যুদণ্ড
আসামি আব্দুল মান্নান মনাই ১৯৭১ সালের ১৯ মে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করেন। তিনদিন বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতনের পর জুরি বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাসকে হত্যা করা হয়। শ্রীনিবাস দাস কোনোক্রমে প্রাণে বেচে যান এবং দুদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন।
দ্বিতীয় অভিযোগে দুই ভাই আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও আব্দুল মতিনের মৃত্যুদণ্ড
১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে, আসামিরা বড়লেখা থানার বিওসি কেছরিগুল গ্রাম থেকে সাফিয়া খাতুন ও আবদুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প ও বড়লেখা সিও অফিসে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়েও সাফিয়া খাতুনকে ধর্ষণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া খাতুনকে সিও অফিসের বাংকার থেকে উদ্ধার করে।
তৃতীয় অভিযোগে আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও আব্দুল মতিনকে ১৫ বছর কারাদণ্ড
১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে বাড়ির মালামাল লুটপাট করে। রাজাকারেরা মঈনের বাবা বছির উদ্দিন, নেছার আলী, ভাই আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে তারা মুক্তি পান।
চতুর্থ অভিযোগে তিন আসামির সবাইকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড
১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মস্তকিন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে। মস্তকিনকে না পেয়ে তার ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙে যায়। আসামিরা মস্তকিন ও মতছিন আলীর বাড়ির মালামাল লুট করে তিনটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেয়।
পঞ্চম অভিযোগে দুই ভাই আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মতিনের মৃত্যুদণ্ড
১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন্য বাড়িতে হামলা করে তারা। সেখান থেকে আসামিরা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে আসামিরা আফিয়া বেগমকে ধর্ষণ করে। হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর বাড়ির মালামালও লুটপাট করা হয়।
এফএইচ/জেডএইচ/এমএস