বিশ্বজুড়ে করোনা : বিদেশে যেমন আছেন বাংলাদেশিরা
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। পৃথিবীর এ দুর্যোগময় সময়ে ভালো নেই বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীরা। তাদের কেউ আছেন ছাঁটাইয়ের আতঙ্কে আবার কারও বেতন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আর খাবার সংকটে ভুগছেন অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে বসবাসরতদের অনেকেই। এছাড়া বাংলাদেশ নিয়ে সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর প্রবাসীদের নিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তারা।
জাগো নিউজের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।
সৌদি আরবের দাম্মামে প্রায় দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে চাকরি করেন ফজলুল ঢালী। তিনি অনলাইনের মাধ্যমে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করি, সেখানে বাংলাদেশি ও ভারতীয় মিলে ১৫০ জন আছেন। সৌদিতেও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। চাহিদা মতো জিনিসপত্র পাচ্ছি না। এই শহরের অনেক কোম্পানির মালিক ইঙ্গিত দিচ্ছেন, চলতি মাসের বেতন নাও দিতে পারেন। অন্যদিকে, করোনা আতঙ্ক। আবার দেশে থাকা আপনজনদের জন্য রাতে ঘুমাতে পারছি না। সৌদিতে সন্ধ্যা ৭ থেকে পরে পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত কারফিউ চলছে। এ সময় বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ। আর অন্য সময় একসঙ্গে একের অধিক লোক দেখলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক।’
তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি আরবের মতো দেশে এমন পরিস্থিতি দেখতে হবে কোনো দিন কল্পনাও করতে পারিনি। এখানে হজ বন্ধ, এটা তো এখন সবার জানা। এছাড়া আজান হলেও মসজিদে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। মুসলিম হিসেবে এটা আমাদেরকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।’
নিউজিল্যান্ডের অটোয়া প্রদেশে ডানেডিন শহরের যানচলাচল পরিকল্পনার ওপর ইউনিভার্সিটি অফ ওটাগোতে পিএইচডি করছেন লুৎফর রহমান। স্বামীর কারণে শিশু সন্তান লিয়ানকে নিয়ে সেখানে আছেন রওশন জাহান হ্যাপি।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সোমবার (২৩ মার্চ) থেকে আগামী চার সপ্তাহের জন্য পুরো দেশ লকডাউন করা হয়েছে। এখানে কেনাকাটার সমস্যা বলতে সবাই মজুত করছে। সুপার মার্কেটগুলো ফাঁকা। আমি আগে থেকেই বাসায় কিছু কিছু জিনিস মজুত রাখি। সেজন্য আর নতুন করে কিছু মজুত করিনি। এটি খুবই ছোট শহর। বাঙালিও কম। এখানে সবাই মিলে ১০০ জনের মতো বাংলাদেশি হবে। সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।’
রওশন জাহান আরও বলেন, ‘গত মঙ্গলবার ডানেডিনে প্রথম একজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তখন থেকেই আমি আর আমার ছোট্ট ছেলে লিয়ান বাইরে বের হচ্ছি না। লিয়ানের বাবা শুধু ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিল। কিন্তু সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আজকে থেকে সেও ঘরে থাকবে।’
অস্ট্রেলিয়ার পার্থে দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে আছেন জাকিরুল হুদা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পার্থে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় এ পর্যন্ত ১৪০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ জন মারা গেছেন। এখানে স্কুল খোলা থাকলেও জিম ও পাব বন্ধ। মার্কেটে লোক কম।’
তিনি বলেন, ‘আতঙ্ক সাধারণত নির্ভর করে মানুষের ওপর। এখানে বসবাসরত পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি আতঙ্কিত। তবে এখনও কোনো বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। বাংলাদেশ নিয়ে আমরা খুব আতঙ্কিত।’
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে থেকে প্রায় ৪২০ কিলোমিটার দূরে নিউ সাউথ ওয়েলসের টেমোর্থ শহরে বসবাস করেছেন তরুণ বাংলাদেশি এ এইচ এম হুমায়ুন করীর হিমেল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন বাংলাদেশি আছি। তবে খাবার কিনতে কষ্ট হচ্ছে। সরকার এখনও জরুরি অবস্থা জারি না করায় কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতাও পাচ্ছি না। প্রথমে করোনাভাইরাস পরীক্ষার করার জন্য কিট ছিল না। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশিরা সবাই ভালো আছি। কিন্তু দেশে অবস্থানরত পরিবারের চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।’
লন্ডনে বসবাসকারী লায়লা আর্জুমান বলেন, ‘আমরা সবাই ঘরে বসে আছি। তবে সুপার মার্কেটগুলোতে প্রচণ্ড ভিড়। একটা জিনিস কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। যা আগে কখনও হয়নি। সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করছি। এই অবস্থায় অনেক প্রবাসী দেশে গেছেন। কারণ এদের অনেকেই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। অনেকের মধ্যে একটি ইমোশন কাজ করছে- মরলে দেশে গিয়ে মরব, আত্মীয় স্বজনদের কাছে মরব। কেউ কেউ ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে গেছেন যে বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেশি। এরকম নানা কারণে তারা দেশে গেছেন। প্রবাসীদের নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে তা ভালো লাগে না। বিদেশ মানেই তো করোনা না।’
কুয়ালালামপুরে বসবাসকারী মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা কেউ ভালো নেই। প্রবাসীদের নিয়ে যে ধরনের নেতিবাচক ধারণা হয়েছে তাতে আমি ক্ষুব্ধ। আমরা দেশে ফেরার পর ভালো একটা জায়গায় রাখলেই তো হত। তা না করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর ফ্লাইটও বন্ধ করতে পারত সরকার। এ সব না করে শুধু প্রবাসীদের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। যেন তারাই সব কিছুর জন্য দায়ী।’
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৩৩ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ৩৩ জনের ১৩ জনই বিদেশ থেকে এসেছেন। বাকি আক্রান্তদের বেশিরভাগই প্রবাসীদের সংস্পর্শে আক্রান্ত হয়েছেন। এদিকে, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রবাসফেরতরা ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন মানছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এ সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে আগতদের নিয়ে দেশের মানুষের মাঝে এক ধরনের বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে বলে প্রবাসীরা আশঙ্কা করছেন। তবে প্রবাসীরা মনে করেন, বিদেশফেরত মানেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না।
এইচএস/এফআর/এমএস