স্বপ্ন নয়, করোনা যাবে বাড়ি
মিলন মাহমুদের গাওয়া ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার/ পথ দেব পাড়ি তোমার’ গানটি সব বাঙালির প্রাণের গান। দুই ঈদেই মানুষ এই গানটি শুনতে শুনতেই বাড়ি ফেরেন। এখন হাজারো মানুষ বাড়ির পথে। মিলনের গানের কথার মতোই ছুটে যাচ্ছে ‘সেই হাসির টানে .... স্মৃতির কোলে।’
এবার বাড়ি ফেরার যাত্রায় আমাদের স্মৃতির কোলগুলোতে কী সবাই ‘স্বপ্ন’ নিয়েই যাচ্ছে? নাকি করোনাভাইরাস?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা ও সঙ্গ-নিরোধ। সামাজিক দূরত্ব বলতে পরস্পরের মধ্যে ছয় ফুট বা প্রায় দুই মিটারের ব্যবধান বজায় রাখতে হয়।
করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। অথচ মহামারির এ ছুটকে জনগণ উৎসবে পরিণত করেছে। ২৩ মার্চ থেকে হাজার হাজার মানুষ যেভাবে বাড়ির পথে ছুটছেন, তাতে বাড়িতে স্বপ্ন নয়, পৌঁছাচ্ছেন এক একজন করোনা বাহক। যা আমাদের নিরাপদ গ্রামগুলোকে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই মুহুর্তে আমাদের কাজ হচ্ছে যার যার বাসায় অবস্থান করা। মানুষের হাঁচি-কাশিসহ বিভিন্ন কারণে করোনাভাইরাসের বিস্তার হতে পারে। তাই সবার উচিত গণপরিবহনসহ লঞ্চ-ট্রেনে ভ্রমণ না করা। সরকারি নির্দেশনা মেনে চলা। আর যারা ইতোমধ্যেই বাড়ি চলে গেছেন, তাদের প্রথম কাজ হবে নিজের পরিবার ও আশপাশের মানুষ থেকে দূরে থাকা।’
চীনা সাংবাদিক ডেনিশ নরমিলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীন যখন করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলো ঠিক একই সময়ে ২৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৯০৯ এ পৌঁছে যায়। কিন্তু গত ১৭ মার্চ সেখানে এ সংখ্যা ৮৪ জনে নেমে আসে। এটা সম্ভব হয়েছে কোনো লকডাউন ছাড়াই, শুধুমাত্র সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমেই।
তবে চট্টগ্রামের বাস টার্মিনালগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করার ফুসরত নেই কারোই। বুধবার (২৫ মার্চ) সকালে নগরের অক্সিজেন, বটতলি ও বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাজার হাজার মানুষ বাড়ি যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে এই কারণেই তারা আজ যেকোনোভাবে বাড়ি পৌঁছাতে চাচ্ছেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়েই সপরিবারে বাড়ির পথে ছুটছে তারা। এক্ষেত্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া বা ছড়িয়ে দেয়ার আশঙ্কাকে আমলেই নিচ্ছেন না তারা। অনেকে বাড়ি যাচ্ছেন সে বিষয়টিও লুকাতে চাইছেন গণমাধ্যমের কাছে। ভিড়ে ঠাসা এমন গণপরিবহনের কারণেই করোনা পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
ইউনিক পরিবহনের ম্যানেজার নুরুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতকাল থেকে বাস যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। অনেকে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে যেতেও রাজি হচ্ছে। অনেকে আসছেন পরিবার-পরিজনসহ। এদের দেখে মনে হচ্ছে না দেশে কোনো মাহামারি এসেছে, সবাই যেন ছুটি কাটাতে বাড়ি যাচ্ছে। টিকিট না পেলে কাউন্টারে হট্টোগোলও শুরু করছেন অনেক যাত্রী।’
কাউন্টারে অপেক্ষমান যাত্রী সারোয়ার বলেন, ‘ঈদেও এতো লম্বা ছুটি পাওয়া যায় না। তাই সবাই পরিবারের কাছে যাচ্ছে, এ ছুটি আরও আগে দেয়া উচিত ছিল। তাহলে আমরা সবাই নিরাপদে যেতে পারতাম।’
তার মতে, ‘সৃষ্টিকর্তা রোগ দিলে কেউ বাঁচাতে পারবে না, তাই অত ভেবে লাভ নেই।’
বটতলি বাস টার্মিনাল এলাকায় কথা হয় নির্মাণ শ্রমিক তোফায়েলের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাটহাজারীর ফতেয়াবাদে একটি ভবনে কাজ করছিলাম। গতকাল কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজ না থাকলে খাবো কী? তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি যাচ্ছি।’
মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত রেলস্টেশনে ছিলো টিকিট সংগ্রহের দীর্ঘ লাইন, বিকেল হতেই দেখা গেল অগ্রিম টিকিট ফেরত দেয়ার দীর্ঘ লাইন। এতে সকাল-বিকেল স্টেশনে ছিল উপচে পড়া মানুষের ভিড়।
মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) বিকেলে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ছুটিতে বাড়ি যেতে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে ভিড় করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। যদিও কাউন্টার থেকে বারবার বলা হচ্ছে সব ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু বাড়ি পাগল মানুষরা সেকথা শুনতে নারাজ।
স্টেশনে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য টিকিট নিয়েছিলেন তিনি, যাত্রা বাতিল হওয়ায় টিকিট ফেরত দিতে রেলস্টেশনে এসেছেন তিনি। একজন সচেতন মানুষ হয়ে কেন ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আর যেন বাড়ি থেকে বের হতে না হয়, সে জন্যই বাড়ি যাচ্ছি।’
চট্টগ্রামে কর বিভাগের একজন কর্মচারী দু’দিন ধরে সর্দি-জ্বরে ভুগে বাড়ি ফিরেছেন মঙ্গলবার। এ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ায় তার শুভাকাঙ্ক্ষিরা তাকে বাড়ি যেতে নিষেধ করলেও তিনি তা মানেন নি।
জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুরুতে তিনি পুরো বিষয়টি গোপন করেন। পরে তিনি বলেন, ‘আমি বাড়ি গিয়ে আলাদা থাকব কয়েকদিন।’
এমএফ/পিআর