শবে বরাতেও সুনসান নীরবতা আজিমপুর কবরস্থানে
‘ভাই গেটটা একটু খোলেন। শবে বরাতের এই ভালো দিনে বাবার কবরটা জিয়ারত কইরা এক্ষুণি চইল্যা আমু।’ আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুর ১টায় আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে তালাবদ্ধ প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষীকে অনুনয়-বিনয় করে এ কথা বলছিলেন এক তরুণী গৃহবধূ।
এ সময় নিরাপত্তারক্ষী অসহায় দৃষ্টিতে ওই তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা বাপ-মার কবর জিয়ারত করবেন আমাগো কী আপত্তি আছে। কিন্তু আমাগো হাত-পা বাঁধা। করোনাভাইরাসের কারণে সরকারিভাবে কবর জিয়ারত নিষেধ আছে। দ্যাহেন না কোনো গেট খোলা নেই। শুধু কেউ মারা গেলে তার স্বজনরা দাফনের জন্য ভেতরে ঢুকতে পারবেন। তাও আবার ভেতরে নির্দিষ্ট দূরত্বে ফাঁক ফাঁক অইয়া দাঁড়াইতে অইবো।’
গেটে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কবরস্থানের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দোয়া-দরুদ পাঠ করে মোনাজাত করেন ওই গৃহবধূ, তার স্বামী এবং ছোট বোন।
আজিমপুর কবরস্থানের সহকারী মোহরার নুরুল হুদা বৃহস্পতিবার দুপুরে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, অন্যান্য বছরের শবে বরাতের দিনের সঙ্গে আজকের শবে বরাতের দিনের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। অন্যান্য বছর কাকডাকা ভোর থেকে আজিমপুর কবরস্থানে রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কবর জিয়ারত করতে আসেন সবাই।
তিনি আরও বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদিন মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। প্রায় প্রতিটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কোরআন-হাদিস ও অন্যান্য দোয়া-দরুদের বই নিয়ে সুরা-কালাম পাঠ করেন লোকজন। প্রতি বছর শবে বরাতের দিনরাত মিলিয়ে আনুমানিক ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষের জমায়েত হয় এ কবরস্থানে। তাছাড়া কবরস্থানের উত্তর ও দক্ষিণ গেটসহ আশপাশের এলাকায় ভিক্ষুকরা সাহায্যের আশায় ভিড় জমান। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে সরকারিভাবে কবর জিয়ারত নিষিদ্ধ। শুধু লাশ দাফন করতে এলে কবরস্থানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সরেজমিনে কবরস্থান ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ এই আজিমপুর কবরস্থানজুড়ে সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। ভরদুপুরেও গা ছমছম পরিবেশ। গাছের পাতা ঝরার শব্দও কানে বাজে। ৭ লাখ তো দূরের কথা ৭ জন মানুষও পুরো কবরস্থান ঘুরে দেখা পাওয়া গেল না।
কবরস্থানের উত্তর গেটের অদূরে একজনকে কাঁথা মুড়িয়ে নবজাতকের লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তিনি জানান, তার শ্যালকের স্ত্রী আজ সকালে মৃত নবজাতক প্রসব করেন। তাকে দাফন করতে এসেছেন। তার শ্যালক গেছেন বাঁশ-চাটাই এসব আনতে। মানুষজন না থাকায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভয়ই লাগছে বলে জানান তিনি।
আজিমপুর কবরস্থানের দক্ষিণ গেট সংলগ্ন প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জামে মসজিদ সংলগ্ন গেটের পাশে ব্যারিকেড দিয়ে প্রবেশপথ আটকে রাখা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দোয়া পাঠ করছিলেন রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের।
তিনি জানান, প্রতি বছরই তার বাবা মায়ের কবর জিয়ারত করতে আসেন তিনি। বিকেল ও রাতে ভিড় হয় বলে দুপুরের দিকে এসে ঘণ্টা দুয়েক কবরের সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া-দরুদ পাঠ করে চলে যান। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার কবর জিয়ারত নিষেধ করায় নিরুপায় হয়ে কবরস্থানের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
এমইউ/ এমএফ/পিআর