করোনায় বেড়েছে সব নিত্যপণ্যের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:২১ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০২০

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত দেড় মাসে চাল, ডাল, তেল, চিনি, দুধ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মরিচ, হলুদ থেকে শুরু করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম ২-৩ গুণও বেড়েছে।

ক্রেতাদের অভিযোগ, করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী একের পর এক পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। এসব ব্যবসায়ী মানবতার দিকে না তাকিয়ে শুধু মুনাফা বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন।

বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এর পরদিনই বেড়ে যায় চালের দাম। ৫২ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া চিকন চালের দাম এক লাফে ৬০ টাকায় উঠে যায়, যা পর্যায়ক্রমে বেড়ে এখন ৬৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। দাম বাড়ার এ তালিকায় রয়েছে গরিবের মোটা চালও। করোনার আগে ৩২ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মোটা চলের দাম বেড়ে এখন ৫০ টাকা হয়েছে।

চালের পাশাপাশি দাম বেড়েছে প্যাকেট এবং খোলা আটা-ময়দারও। করোনার আগে ২৬ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া খোলা আটার দাম বেড়ে ৩২ টাকা হয়েছে। প্যাকেট আটার দাম ৩৪ থেকে বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। করোনার আগে ৩২ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া খোলা ময়দা ৪৫ টাকা ছুঁয়েছে। প্যাকেট ময়দার দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে।

করোনার প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। ভোজ্যতেল হিসেবে অধিক ব্যবহৃত সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম করোনার মধ্যে বেড়েছে একাধিক দফায়। করোনার আগে ৭০ টাকা লিটার বিক্রি হওয়া পাম অয়েলের দাম বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। সুপার পাম অয়েলের দাম ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

দাম বাড়ার এ তালিকায় রয়েছে লুজ ও বোতলের উভয় ধরনের সয়াবিন তেল। তবে বোতলের থেকে লুজ সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির হার একটু বেশি। করোনার আগে ৮৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া লুজ সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে ১০০ টাকায় পৌঁছেছে। এক লিটারের বোতল ১০০ থেকে ১১০ টাকা এবং ৫ লিটারের বোতল ৪৬০ থেকে বেড়ে ৫২০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে।

করোনার প্রকোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে মসুর, মুগ, অ্যাংকর ডাল ও ছোলার দাম। বড় দানার মসুর ডালের কেজি বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে, যা করোনার আগে ছিল ৭০ টাকার নিচে। ৮০ টাকার মাঝারি দানার মসুর ডালের কেজি বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। ছোট দানার মসুর ডালের কেজি পৌঁছেছে ১৪০ টাকায়, যা করোনার আগে ছিল ১১০ টাকা।

এদিকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মুগ ডালের দাম বেড়ে হয়েছে ১৪০ টাকা। অ্যাংকরের দাম বেড়ে ৫০ টাকা ছুঁয়েছে, যা করোনার আগে ছিল ৩৫ টাকা। ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ছোলার দাম বেড়ে হয়েছে ৮৫ টাকা। ১৮ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া গোল আলু ২৮ টাকা হয়েছে। ৬২ টাকার খোলা চিনির কেজি ৭৫ টাকা হয়েছে।

গরম মসলার বাজার

করোনার আগে ৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেঁয়াজের কেজি এখন ৬০ টাকা। ৬০ টাকার দেশি রসুনের দাম বেড়ে ১৪০ টাকা হয়েছে। যে আমদানি করা রসুন করোনার আগে ১০০ টাকা ছিল তা এখন ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ১৬০ টাকার শুকনা মরিচের দাম এক লাফে বেড়ে ৩৫০ টাকা হয়েছে। ১২০ টাকার হলুদের দাম বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে। ১০০ টাকা থেকে আদার কেজি ৩৫০ টাকায় পৌঁছেছে।

করোনার আগে ৩৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া জিরার দাম বেড়ে এখন ৪৫০ টাকা ছুঁয়েছে। ৪০০ টাকার দারুচিনি ৫০০ টাকা হয়েছে। লবঙ্গের দাম বেড়ে ১২০০ টাকা হয়েছে কেজি, যা করোনার আগে ছিল ৮০০ টাকার মধ্যে। ৩৫০০ টাকার এলাচের দাম বেড়ে চার হাজার টাকা হয়েছে। ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ধনের দাম বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। তেজপাতার কেজিও ১৫০ টাকা ছুঁয়েছে, যা করোনার আগে ছিল ১০০ টাকার মধ্যে।

মাংসেও করোনার আঘাত

দীর্ঘদিন ধরেই চড়া দামে বিক্রি হওয়া গরু ও খাসির মাংসের দাম করোনার প্রকোপের মধ্যে আরও বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৬০০ টাকা কেজিতে পৌঁছেছে গরুর মাংসের দাম। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ টাকা পর্যন্ত। করোনার আগে গরুর মাংস ৪৬০ টাকা এবং খাসির মাংস ৮৫০ টাকার মধ্যে ছিল। গরু ও খাসির সঙ্গে দাম বেড়েছে মুরগির। করোনার আগে ১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির কেজি এখন ১৩০ টাকা হয়েছে। আর ৪০০ টাকার দেশি মুরগির কেজি হয়েছে ৫০০ টাকা।

রক্ষা পায়নি দুধও

করোনার প্রকোপের মধ্যে দাম বাড়ার তালিকা থেকে রক্ষা পায়নি বিভিন্ন কোম্পানির গুঁড়া দুধও। করোনার আগে ৫৮০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ডানো দুধের দাম বেড়ে হয়েছে ৬৩০ টাকা। ৫৯০ টাকার ডিপ্লোমা হয়েছে ৬২০ টাকা। ৪৮০ টাকার ফ্রেশের দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫০ টাকা। মার্কস দুধের কেজি হয়েছে ৫৬০ টাকা, যা করোনার আগে ছিল ৫৪০ টাকা।

রোজা বাড়িয়েছে সবজির দাম

করোনা প্রকোপের মধ্যে একের পর এক পণ্যের দাম বাড়লেও সবজিতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন ক্রেতারা। তবে রোজা এসে সবজির দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। রোজার শুরুতেই মোকামের তুলনায় ঢাকায় সবজির দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ১৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া টমেটোর দাম বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। এছাড়া ২০ টাকার বেগুন ৮০, ২০ টাকার শসা ৫০, ২০ টাকার গাজর ৪০, ২০ টাকার পেঁপে ৫০ টাকা হয়েছে। তবে পটল, ঢেঁড়স, চিচিংগা এখনও কিছুটা কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এ সবজিগুলো আগের মতোই ৪০ টাকা কেজির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।

ক্রেতাদের অভিমত

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা মানিক বলন, ‘করোনার আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এই সংকটের মধ্যে পণ্যের দাম না বাড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা একদিকে সরকার কাছ থেকে সুবিধা হাতাচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে মুনাফা লুটছে। মাঝখানে ভোগান্তির মধ্যেই থাকছে মানুষ।’

রামপুরার বাসিন্দা ইয়ানুর বলেন, ‘করোনার মধ্যে যেভাবে একের পর এক পণ্যের দাম বাড়ছে তা কিছুতেই স্বাভাবিক না। মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষকে জিম্মি করে সবকিছুর দাম বাড়াচ্ছে। কিছুদিন আগে ভোক্তা অভিযানে বেরিয়ে এসেছে যে, আদার দাম ১০০ টাকার নিচে, সেই আদা ৩০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এরপরও আদার দাম কমেনি। উল্টো বেড়ে এখন সাড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। একইভাবে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার খরব আসছে না।’

যা জানালেন খুচরা ব্যবসায়ীরা

হাজীপাড়ার ব্যবসায়ী আলম বলেন, ‘করোনায় সবার আগে বেড়েছে চালের দাম। এরপর পেঁয়াজ, রসুন, আটা, তেল, শুকনা মরিচ, আদা, ডাল, হলুদের দাম পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার কারণে এভাবে সবকিছুর দাম বেড়েছে।’

রামপুরার ব্যবসায়ী শামছু বলেন, ‘বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, দুধ সবকিছুই আছে। তবে আগের থেকে সরবরাহ কম এবং দাম বেশি। ঢাকার বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ ও দাম নির্ভর করে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ এবং শ্যামবাজার ও বাবু বাজারের ব্যবসায়ীদের ওপরে। তারাই ভালো বলতে পারবেন, কেন সবকিছুর দাম বাড়ছে। তবে আমার যতটুকু বুঝ, করোনাভাইরাস না হলে বেশিরভাগ পণ্যের দামই বাড়তো না।’

এমএএস/এফআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।