মানুষ জানতে চায় কোন হাসপাতালে বেড-আইসিইউ ফাঁকা আছে
রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা সুলতান আহমেদ তিন দিন ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তার এক নিকটাত্মীয়কে ভর্তির জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করছেন। যে হাসপাতালেই তিনি সশরীরে গিয়েছেন সেখানে গিয়ে শুনেছেন বেড খালি নেই। হঠাৎ করেই ওই রোগীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তিনি আইসিইউয়ের একটি বেডের জন্য একাধিক হাসপাতালে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরে পরিচিত একজনের মাধ্যমে একটি হাসপাতালে দ্রুত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে কোনোভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সুলতান আহমেদ বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা যে কত কঠিন কাজ ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবেন না।
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে দাবি করলেও বাস্তবে বর্তমানে করানোর রোগীদের সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা প্রাপ্তি দুরূহ হয়ে পড়ছে।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে গৎবাঁধা কিছু তথ্য-উপাত্ত (২৪ ঘণ্টায় কত নমুনা সংগ্রহ, কতগুলো পরীক্ষা, এ সময় আক্রান্ত, মৃত্যু, কতজন সুস্থ হলেন) প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ জানতে চায় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য কোন হাসপাতালে কতগুলো সাধারণ ও আইসিইউ বেড রয়েছে। সেগুলোতে কত রোগী ভর্তি আছে। কতগুলো আইসিইউ বেড ফাঁকা রয়েছে। কিন্তু ব্রিফিংয়ে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য জানানো হয় না কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত হাসপাতালের জরুরি বিভাগ কিংবা অন্য কোথাও প্রদর্শন করে না। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করাতে গিয়ে চিকিৎসকদেরও ঘাম ঝরাতে হচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক জানান, সম্প্রতি তার ভাতিজা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তিনি ইস্কাটন এলাকার একটি বেসরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। নিজের পরিচয় দিয়ে ভাতিজাকে ভর্তি করানোর জন্য অনুরোধ জানালে তাকে জানানো হয়, বেড ফাঁকা থাকলেও নির্দিষ্ট একটি বাহিনীর জন্য বেডগুলো সংরক্ষিত রয়েছে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ওই চিকিৎসক বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে এখন বিভিন্ন বাহিনী ও প্রভাবশালী লোকদের জন্য বেড বরাদ্দ করে রাখা হচ্ছে। যে রোগীর অবস্থা এ মুহূর্তে খারাপ, তাকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা হলে তিনি প্রাণে বেঁচে যাবেন সে ধরনের রোগীকে ভর্তি করে চিকিৎসা না দিয়ে কোনো বাহিনী কিংবা প্রভাবশালী কেউ কখন আক্রান্ত হবেন তার জন্য বেড বরাদ্দ করে রাখা সম্পূর্ণ অমানবিক আচরণ। পরবর্তীতে তিনি হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছিলেন, বেড ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও রোগী ভর্তি না করার ফলে রোগীর খারাপ কিছু হলে তিনি গণমাধ্যমকে ডেকে সব কিছু বলে দেবেন এবং এর দায়-দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। এ কথা শোনার পর তিনি তার ভাতিজাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে সমর্থ হন বলে জানান।
রাজধানীসহ সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত এবং ১৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয়। ২৩ জুন পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক হাজার ৫৮২ জন। করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ২২ হাজার ৬৬০ জন।
এদিকে করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতাল এবং বাসায় অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেনের কাছে হাসপাতালে রোগীরা ভর্তি হতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন জানিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলো রোগী ও তাদের স্বজনদের অবহিত করার জন্য জরুরি বিভাগের আশপাশে ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে কিংবা করোনা তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিদিনের রোগীর তথ্য (কত রোগী ভর্তি আছে, কতজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন, কতজন সুস্থ হলেন) প্রদর্শন করতে পারে। এতে রোগীর স্বজনরা জানতে পারবেন কোন হাসপাতালে গেলে রোগী ভর্তি করা যাবে।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, 'করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনদের অধিকাংশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভিড় করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রায়ই বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে ২ হাজার বেডের আইসোলেশন সেন্টারে রোগীর চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে বললেও সেখানে রোগী যাচ্ছে না।'
নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে রাজধানীর কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কতগুলো শয্যা কিংবা আইসিইউতে রোগী ভর্তি রয়েছে, কতগুলো ফাঁকা রয়েছে ইত্যাদি পরিসংখ্যান নিয়মিত সরবরাহ করা যায় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে এবং রিলিজ পাচ্ছে। ফলে প্রতিদিন হিসাব করে সে পরিসংখ্যান প্রেস ব্রিফিংয়ে নিয়মিত বলা একটু কঠিন ব্যাপার। তবে ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে রোগীদের হালনাগাদ পরিসংখ্যান দেয়ার ব্যাপারটি তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানান।
এমইউ/জেডএ/এমএস