বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ বাড়ছে যে কারণে

কলকাতার এক কালীমন্দিরের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান যেভাবে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, বাধ্য হয়েছেন প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে। গত সপ্তাহে এ নিয়ে ‘সাকিবের ক্ষমা প্রার্থনা এবং মৌলবাদের সাম্প্রতিক চিত্র’ শিরোনামে লিখতে গিয়ে বলেছিলাম আমাদের সোসাইটি এত দ্রুত মৌলবাদী মানসিকতায় আচ্ছন্ন হচ্ছে কেন- এটা নিয়ে আরেক দিন বলবো।
সাম্প্রতিক সময়ে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামপন্থী দলগুলো ঢাকার রাজপথে ফ্রান্সবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক শোডাউন করে তাদের শক্তিমত্তা দেখিয়েছে। আবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারের আড়ালে চিহ্নিত কিছু হিন্দু মৌলবাদী রাজপথে হিন্দুদের শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। রাজপথ অবরোধ করেছে। ভারতীয় আরএসএস’র শাখা হিসেবে কারা সহি হিন্দুধর্মীয় সংগঠন- এটা নিয়েও হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠনের মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগিতা বেড়েছে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না ধর্মীয় মৌলবাদ কীভাবে দিন দিন বাড়ছে।
আমাদের দেশ ভাগ হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান আর হিন্দুদের জন্য ভারত। আবার অভিভক্ত বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ায় বার বার বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্ব মুসলমানদের হাতে যাচ্ছে বলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এ সবই হয়েছে সাম্প্রদায়িক চিন্তার ভিত্তিতে। সেই কারণে বলবো সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ আমাদের সমাজে নতুনও নয়। এটি সমাজ থেকে কখনও মুছে যায় আমি সেটা বিশ্বাসও করি না। সুপ্তভাবে সব সময় আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে সেটা আমেরিকায় চাঙ্গা হয়, নরেদ্র মোদি ক্ষমতায় আসলে ভারতে চাঙ্গা হয়- পার্থক্য এটাই। আবার তাদের বিরুদ্ধ শক্তি ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্র সেক্যুলারিজমের চর্চা করে।
কথা আসতে পারে বাংলাদেশে তো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ক্ষমতায় নেই দীর্ঘদিন, তাহলে এখানে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কেন? বাংলাদেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার পেছনে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং দেশীয় রাজনীতির প্রভাবকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বৈশ্বিক বিষয়ে বলতে হয়, পশ্চিমা সমাজে মুসলমানরা নানা অজুহাতে এখন কোণঠাসা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের জন্য পশ্চিমাদের নানা আগ্রাসন আর ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা মিডিয়ায় সুইসাইড বোম্বার হিসেবে মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসী’ ইমেজ তো গড়ে উঠেছে কয়েক যুগ আগেই। অতি সম্প্রতি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন বানানোকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে যা ঘটছে, যাকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবাধিকারের নামে ‘ফ্রান্সের দ্বৈতাচার’ হিসেবে দেখছে, সেই ধরনের ঘটনাবলি ধর্মীয় উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা বাড়ার ক্ষেত্রে এখানে যে ভূমিকা রাখছে তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
পশ্চিমাদের ‘ইসলাম ফোবিয়ার’ কাউন্টার হিসেবে ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে কাতারের আলজাজিরা কথা বলা শুরু করে। সে কারণে তারা পশ্চিমাদের চক্ষুশূল হয় এবং আফগান যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ- দুটি যুদ্ধেই আলজাজিরার স্থানীয় অফিস বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তাদের সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। দীর্ঘদিন আমেরিকায় আলজাজিরা-ইংলিশ সম্প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।
২০০৩ সালে তুরস্কে রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। মুসলমানদের কাছে উসমানীয় সাম্রাজ্য অনেক বেশি আবেগের, যা ঐতিহাসিকভাবে তুর্কি সাম্রাজ্য বা অটোমান সাম্রাজ্য বলে পরিচিত। এরদোয়ান এই আবেগকে কাজে লাগাতে তুরস্কে অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরবগাঁথা নিয়ে নির্মাণ করতে থাকেন একের পর এক ঐতিহাসিক সিনেমা এবং টিভি সিরিয়াল, যা নির্মাণের দিক থেকে বিশ্বমানের। পুরো মধ্যপ্রাচ্য, সেন্ট্রাল এশিয়া এবং ইসলামিক দেশগুলোতে এগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের সঙ্গে তরুণ সমাজকে ইসলামমনষ্ক করতে সহায়তা করছে। ইসলামী মৌলবাদী দলগুলো এসব তরুণকে স্বপক্ষে আনার জন্য সহজে টার্গেট করতে পারছে।
এর মধ্যে তুরস্ক ২০১৫ সালের জুনে তাদের রাষ্ট্রীয় টিভি ও বেতার সংস্থা টিআরটির অধীনে ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’ চালু করেছে- সেটিও ইসলাম ফোবিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করছে এখন। আলজাজিরা, টিআরটি নিরপেক্ষতা বজায় রেখে মুসলিম বিশ্বের মনোভাবও তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এখন পুরো মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। মধ্যপ্রাচ্যে তার জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় এবং এটাকে আরব শেখরা কেউ কেউ হুমকি হিসেবেও ভাবছেন। তুমুল জনপ্রিয় তিনি পাকিস্তান ও ইরানে। বাংলাদেশে মৌলবাদী শ্রেণির কাছে এরদোগান কতটা জনপ্রিয় সেটা অনেকে খবর রাখেন না। মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক এই জাগরণ থেকে বাংলাদেশ বাইরে নয় এবং এখানে মৌলবাদ চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে এর একটা নীরব ভূমিকা আছে। নাইন-ইলেভেনের সময়ে জাকির নায়েক তার বক্তৃতা দিয়ে এই উপমহাদেশে ইসলামি মৌলবাদের জাগরণ ঘটান। ২০০৬ সালে পিস টিভির মাধ্যমে সেটাকেই বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দেন তিনি এবং শেষ পর্যন্ত উগ্র মৌলবাদ ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত হন। তার অনুসারীরা হলি আর্টিজান ঘটায়।
দেশীয় রাজনীতির কথা সংক্ষেপে বললে- বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে ইসলামি জঙ্গি ও মৌলবাদীরা সরকারের প্রশ্রয় পেয়েছে অভিযোগ আছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শূরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই ও আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আবদুর রহমানের উত্থান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ঘটেছে। ব্লগার হত্যা, হলি আর্টিজান তারই ধারাবাহিকতা।
বর্তমান সরকার জঙ্গি দমনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে কিন্তু হেফাজত অনুসারী এবং জামায়াতবিরোধী ইসলামি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে আশকারা দিচ্ছে অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে তাদের সঙ্গে সরকারের গোপন রাজনৈতিক সমঝোতা রয়েছে সে কারণে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ইসলামপন্থীদের বিরোধিতায় আওয়ামী লীগ অস্বস্তিতে পড়েছে। ইসলামপন্থী যে দলগুলো ঢাকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে, তার মধ্যে অন্যতম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ রেজাউল করীম এবং খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে সরকার এখনও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, বিগত বিএনপি সরকার আমলে হিন্দুরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছিল আর বর্তমান সরকার হিন্দুদের এতোটা প্রাধান্য দিচ্ছে যে, মুসলমানরা অনুভব করছে তারা এখন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আবার দিল্লিতে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশি হিন্দু মৌলবাদীরা বেপরোয়া আচরণ করছে। এমনও হয়েছে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এক চিহ্নিত হিন্দু মৌলবাদী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মোদির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারে প্রধান এবং দীর্ঘ মেয়াদি উৎস হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত। ভারতে যখনই মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে বাংলাদেশে হিন্দুদের নির্যাতনে নেমে পড়ে মুসলিম মৌলবাদীরা। সেই ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালী দাঙ্গা থেকে শুরু করে বাবরী মসজিদ ভাঙার সময় ঢাকেশ্বরী মন্দির পোড়ানো, চট্টগ্রামে কৈবল্যধাম মন্দির পোড়ানোসহ আঞ্চলিক মৌলবাদের প্রভাবের এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় না থাকলে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া ও সেখানে মানবাধিকারের চূড়ান্ত লংঘন, গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির দাঙ্গায় ৫৩ জন মুসলমানকে হত্যা, এনআরসিসহ নানা ইস্যুতে মোদি সরকারের মুসলিম নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নেমে আসতো।
গত ১ নভেম্বর কুমিল্লার মুরাদনগরে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। এটি নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার চেষ্টা হয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে কংগ্রেসের দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের ঘটনার প্রভাব সীমান্তের এপারেও পড়তে পারে। সেজন্য তারা চান বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের কাছে উত্থাপন করা হোক। মোদি সরকার নিজেই যখন নিজেদের মুসলিম নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না, খোদ সরকারই নির্যাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তখন বাংলাদেশকে হিন্দুদের নিরাপত্তা বিষয়ে পরামর্শ দিতে আসা লজ্জার বিষয়। বরং ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লিকে তাদের মুসলিম নির্যাতন বন্ধ করার জন্য সতর্ক করার দরকার হয়ে পড়ছে, কারণ ভারতের ঘটনাবলিতেই বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি নষ্টের ঘটনা ঘটছে বার বার।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেখানে জোরে সোরে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা, মুসলিমদের নিয়ে ঘৃণা প্রচার। গায়ে পড়ে ঝগড়া করার তালে আছে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদী ও জঙ্গিরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এরা বেশি সক্রিয়।
অতি সম্প্রতি ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো ছবিটির কথাই ধরা যাক। ভারতীয় একজন নারী বাংলায় লেখা একটা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে লেখা ‘অবিলম্বে বাংলাদেশি মুসলিমদের ভারতে সব চিকিৎসা সুযোগ বন্ধ করে দিতে হবে।’ এটা কী? এটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা এবং উসকানি। নিজের পায়ে কুড়াল মেরে হলেও ঘৃণা চরিতার্থ করা। বাংলাদেশিরা ভারতে চিকিৎসার জন্য না গেলে ভারতেরই ক্ষতি। ভারত এটা বুঝেছে বলেই মেডিকেল ভিসার বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে– চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশি রোগীরা মেডিকেল ভিসা ছাড়া ভারতে চিকিৎসা নিতে ভোগান্তিতে পড়ে বলে ভারত যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। ফলে সেখানকার প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর মালিকরা সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন মেডিকেল ভিসার বাধ্যবাধকতা তুলে দিতে।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যে কোনো রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে মারাত্মক হুমকি। পাকিস্তান সেই রোগের শিকার হয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রের কাতারে চলে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চলছে বলে ভারতের উন্নয়নও পেছনে হাঁটছে দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশিদেরও এটাই মাথায় রাখতে হবে যে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা-সাম্প্রদায়িকতা জাতীয় উন্নয়নের, সুস্থ সমাজ জীবনের জন্য ক্ষতিকর। এসব উগ্রতা সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা রাখেনা। দরকার ধর্ম নিয়ে দেশি-বিদেশি সব চক্রান্ত, উসকানি থেকেও সাবধান থাকা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
এইচআর/পিআর