কাদের মির্জা সত্যি বলেছেন না মিথ্যা?

দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিবিদের নাম কী? আমি জানি এই প্রশ্নের উত্তর আপনারা সবাই জানেন। সেই ব্যক্তিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও নন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নন। ওবায়দুল কাদেরের ‘কাদের’, আর মির্জা ফখরুলের ‘মির্জা’ নিয়ে গঠিত এই আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম কাদের মির্জা। সমন্বয়ের রাজনীতির এক দারুণ উদাহরণ হতে পারেন তিনি। এমনিতে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে টানা তিনবার নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। দুই সপ্তাহ ধরে তার কণ্ঠে মির্জা ফখরুলের সুর। যতটা কড়া ভাষায় কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছেন, আসল মির্জা মানে মির্জা ফখরুলও ইদানীং অত কড়া ভাষায় কথা বলেন না।
তবে নকল কেউ নন, সবাই আসল মির্জা। ছোট ভাইয়ের নাম যদি আবদুল কাদের মির্জা হয়, তাহলে বড় ভাইয়ের নামও তো ওবায়দুল কাদের মির্জা হওয়ার কথা। হয়তো ওবায়দুল কাদের এফিডেভিট করে ‘মির্জা’ বাদ দিয়েছেন বা সার্টিফিকেটে থাকলেও তিনি ‘মির্জা’ ব্যবহার করেন না। ছোট ভাই কাদের মির্জার আলোচনায় আসার মধ্য দিয়ে একটি বিষয় প্রমাণিত হলো, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এখন মির্জা বংশের নিয়ন্ত্রণে। মির্জারা বিষয়টি সেলিব্রেট করতে পারেন।
ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সেজেছিলেন। গত দুই সপ্তাহে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে শুরু করেছেন, তারপর কেন্দ্রীয় নেতা, প্রশাসন কাউকে ছাড়েননি; এমনকি আপন বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরও তার আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। তিনি দলীয় নেতাদের দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, পদবাণিজ্য, অস্ত্রবাজিসহ নানা অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন।
নানা অভিযোগ, সমালোচনার পর তার দাবি ছিল একটাই এবং সেটা ন্যায্য দাবি- সুষ্ঠু নির্বাচন। তার আশঙ্কা ছিল, তাকে হারিয়ে দিতে আওয়ামী লীগেরই একটা অংশ ষড়যন্ত্র করছে। তারা অর্থ, অস্ত্র দিয়ে তাকে ঠেকাতে চাইছে। বাংলাদেশে এখন যে আর সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, সেটা তার কথায় অনেকটাই পরিষ্কার। ‘শেখ হাসিনা ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও ভোটের অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি’ এ কথাটি কিন্তু মির্জা ফখরুলের নয়, কাদের মির্জার। তিনি বলেছিলেন, যদি এক ভোটও পান, আপত্তি নেই। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে।
কাদের মির্জা এক ভোট নয়, বিপুল ভোট পেয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ছয়গুণ ভোট পেয়ে তিনি টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি এবার মানবেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। মজাটা হলো, এবার বসুরহাট পৌরসভার দিকেই সবার নজর ছিল। সকাল থেকে লম্বা লাইনে ভোট হয়েছে। অনেকে বলেছেন, গত ১০-১২ বছরে এমন ভোট তারা দেখেননি। সেই সুষ্ঠু ভোটে কাদের মির্জা জিতেছেন। তাকে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছেন তার বড় ভাই ওবায়দুল কাদের। আমরাও কাদের মির্জার এই জয়ে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
এখন সময় এসেছে কাদের মির্জার বক্তব্য থেকে শিক্ষা নেয়ার, তার বক্তব্য ধরে ব্যবস্থা নেয়ার। হঠাৎ করেই কাদের মির্জা হয়ে উঠেছিলেন জাতির বিবেক। তিনি যা বলেছেন, তার প্রতিটি কথাই আমার কাছে সত্যি মনে হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নোয়াখালী আওয়ামী লীগের অধিকাংশ এমপি পালানোর পথ পাবে না, এই কথা ধরে আওয়ামী লীগের উচিত দ্রুত নিজেদের শুধরে নেয়া, জনগণের কাছে যাওয়া।
কাদের মির্জা যা বলেছেন, তার সবটুকু রাজনীতির কথার কথা নয়। কিছু আছে গুরুতর অভিযোগ। তিনি প্রশাসনের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘গত নির্বাচনে শেখ হাসিনা প্রশাসনের লোকজনের কাছে ফল চেয়েছেন। অতিউৎসাহী প্রশাসনের লোকজন গাছসহ নেত্রীকে দিয়েছেন। এতে নেত্রীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। প্রশাসনের লোকজন বেশি উড়তেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত।’
বসুরহাট পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র কাদের মির্জা কি এই বিচারের দাবিতে অনড় থাকবেন? কাদের মির্জা আরও বলেছিলেন, ‘কোম্পানীগঞ্জে অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে। এ ব্যাপারে নোয়াখালীর প্রশাসন উদাসীন।’ নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী ও ফেনীর এমপি নিজাম হাজারীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘কবিরহাট ও ফেনীতে বসে কোম্পানীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে।’ নবনির্বাচিত মেয়র কি এখন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন বা দলের দুই এমপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগের বিচার চাইবেন?
আবদুল কাদের মির্জার অভিযোগের তালিকা অনেক লম্বা। স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয় নেতা, প্রশাসন, পুলিশ সবার বিরুদ্ধেই তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। এতদিন তার বক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিপুল ভোটে নির্বাচিত একজন পৌর মেয়রকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলার উপায় নেই। নির্বাচন শেষ। এখন তার বক্তব্যের তালিকা নিয়ে বসতে হবে। বসতে হবে দল এবং সরকারকে। যদি কাদের মির্জা মিথ্যা বলেন, তাহলে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি সত্যি কথা বলে থাকেন, তাহলে তিনি যাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন, তাদের সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
কাদের মির্জার কথা হয় সত্যি নয় মিথ্যা। তাই কারও না কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে এবং সেই ব্যবস্থার কথা জনগণকে জানাতে হবে। ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার গুরুতর বক্তব্য বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেয়া উচিত হবে না। মনে রাখবেন কার্পেটের নিচে ময়লা গুটিয়ে রাখলেই ঘর পরিষ্কার হয় না। যত ময়লা আছে সব পরিষ্কার করতে হবে।
১৭ জানুয়ারি, ২০২১
এইচআর/বিএ/এমএস