‘এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না'

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের শোচনীয় পরাজয়ের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সাংবাদিকদের কাছে কিছুটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। আমি আফগানিস্তানের পর বেশিকিছু বলতে চাইনি। কিন্তু আজ আপনাদের বললাম, এটা পরিবর্তন করতে হবে। অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে’।
টেস্ট সিরিজে ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্সকেই বেশি দৃষ্টিকটূ মনে হয়েছে উল্লেখ করে বিসিবি সভাপতি পাপন বলেন, মেহেদী হাসান মিরাজ ছাড়া আর কারও ব্যাটিংই পছন্দ হয়নি তার। তিনি বলেছেন, কোনো দলকেই দেখিনি টেস্ট খেলতে গিয়ে একাধিক খেলোয়াড়ের বারবার এই রকম করে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসতে। দলের মধ্যে পরিকল্পনার অভাবের কথা উল্লেখ করে পাপন বলেছেন, ‘প্রতিটি খেলার আগে একটা পরিকল্পনা থাকতে হয়। প্রতিটা দিন, প্রতিটা সেশনের পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু এখানে সবাই যার যার মতো এসে গিয়ে খেলে দিয়ে গেছে'।
টেস্ট দলে পাঁচ পেসার থাকার পরও চট্টগ্রাম ও মিরপুর টেস্টে একজন পেসার নিয়ে খেলেছে বাংলাদেশ। বিসিবি সভাপতি বলেছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই অনেক ভালো পেসার আছে দলে। পরিবর্তন দরকার ছিল। কিন্তু খেলানো তো হয় না। আমাকে বলা হচ্ছে খেলবে, পরে দেখি নামছে না। সবার কাছেই এর ব্যাখ্যা চাইবো'।
মিরপুর টেস্টে বাংলাদেশ দলের পরাজয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমিকদের মধ্যেও ক্ষোভ এবং হতাশা দেখা দিয়েছে। ২০ বছরেও কেন বাংলাদেশ দল নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে না, একই সমস্যা কেন বারবার দেখা যাচ্ছে সেসব প্রশ্ন উঠছে। টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক বলেছেন, টেস্ট ক্রিকেটের অনেক কিছুই এখনো শেখার বাকি তাদের। ক্রীড়াপ্রেমিকদের মনে প্রশ্ন, আর কবে শিখবে বাংলাদেশ দল? এভাবে কি চলতে পারে? বিসিবি সভাপতি নিজেই বলেছেন, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এখন দেখার বিষয়, পরিবর্তন আসলে হয় কিনা।
দুই.
শুধু ক্রিকেট নয়, দেশের রাজনীতি নিয়েও দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা বাড়ছে। বিএনপি অভিযোগ করছে, দেশে বাকস্বাধীনতা নেই। সরকারবিরোধী মত দমন করছে। আবার সরকারি দলের একজন ছোট মাপের নেতা বাধাহীনভাবে কথা বলেই চলেছেন। আল জাজিরার রিপোর্ট যদি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে, তাহলে আবদুল কাদের মির্জার কথাবার্তা কি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে? এই প্রশ্ন কারো কারো মনে বেশ জোরালোভাবেই উঠছে যে, সরকারি দল যেভাবে চলছে সেভাবেই কি চলতে থাকবে? ক্রিকেটের জন্য একটি কন্ট্রোল বোর্ড আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের জন্য তো কোনো কন্টোল বোর্ড নেই। তবে দলীয় শৃঙ্খলা বলে একটি কথা আছে এবং সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় দলের গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচালিত হয় ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালখুশির ভিত্তিতে। বড় কোনো ঝামেলা দেখা দিলেই কেবল গঠনতন্ত্রে চোখ পড়ে। বিসিবি সভাপতির মতো দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল সম্পর্কে কি কেউ বলতে পারবেন, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল আর এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। রাজনীতিতেও এবং রাজনৈতিক দলে একটি বড় পরিবর্তন দরকার, দরকার গুণগত পরিবর্তন।
সরকারবিরোধী রাজনীতি এখন দেশে নেই বললেই চলে। বিরোধী দল কথায় আছে, কাজে নেই। রাজনীতির মাঠ সরকার এবং সরকারি দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। পৌরসভাগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা একচেটিয়া জয় পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ছিটেফোটা জিতছে। বিএনপির চেয়ে বেশি জয় পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বলা হচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন কাজে সন্তুষ্ট থাকায় মানুষ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদেরই ভোট দিচ্ছে। হতে পারে। মানুষ শান্তি ও স্থিতির পক্ষে বলে আওয়ামী লীগ ভোটে জিতছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভোট কি ভালো হচ্ছে? ভোট নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ তো বন্ধ হচ্ছে না। সংঘাত-সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা আড়াল করা যাচ্ছে না।
সরকার যদি মনে করে থাকে, এখন যেভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও তা সম্ভব হবে, তাহলে বড় ভুল হবে। সরকার যে সব কিছু ভালোভাবে সামাল দিতে পারছে না, তা বিভিন্ন ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে। বিরোধী দল সরকারকে ঘায়েল করতে পারছে না তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং ভুল রাজনৈতিক কৌশলের কারণে। তবে চেষ্টা তারা অব্যাহত রেখেছে। একবার না পারিলে দেখো শতবার নীতি নিয়ে তারা নানামুখী তৎপরতায় লিপ্ত আছে।
বিরোধী দলের চেয়ে সরকারের জন্য বেশি বিব্রতকর হয়ে উঠছে নিজের দল- আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই এখন আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিপক্ষ। একই দলের সরকার টানা ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি যেমন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তেমনি সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোও গোপন থাকছে না। বিভিম্ন পৌরসভা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণেই মারামারি, সহিংসতা বেশি হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমন করা যায়নি। দীর্ঘদিন লাগাম ছেড়ে রাখায় এখন পরিস্থিতি কিছুটা বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথা মুখে বলা হয়, বাস্তবে করা হয় না। বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ সত্ত্বেও কেউ কেউ দিব্যি দলের ছাতা ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সুনাম এবং জনপ্রিয়তা সরকারের জন্য বড় ঢাল হয়ে আছে। কিন্তু একজন মানুষের ওপর অতিনির্ভরতাও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
গত মাস দুয়েক ধরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই আব্দুল কাদের মির্জা যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে যাচ্ছেন, তা অনেকের মনেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেউ কেউ তার কথাবার্তা ‘পাগলের প্রলাপ' বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও তিনি যেভাবে ক্রমাগত একই ধরনের অভিযোগ করে চলেছেন, তা উপেক্ষার পর্যায়ে আছে বলেও মনে হয় না। কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নোয়াখালির বসুরহাট পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। দলের একজন হয়ে দল এবং সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে কথা বলছেন, তা কিন্তু কৌতুক হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়। হয় তার অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা দলে থেকে তিনি এভাবে ‘স্বাধীন মত' প্রকাশ করতে পারেন কিনা সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কাদের মির্জার ‘সত্য’ বলার ধারা অব্যাহত থাকলে সেটা একসময় বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কাদের মির্জা বলেছেন, সরকারি কিছু কর্মকর্তা মনে করেন, আওয়ামী লীগকে তারাই ক্ষমতায় এনেছেন। এ জন্য তারা যা ইচ্ছা তা-ই করছেন। নিজের বড়ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ওবায়দুল কাদের পদ-পদবির জন্য নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারেন। নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমসহ আরো কিছু দলীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাদের মির্জা গুরুতর সব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। নোয়াখালীর অন্যায়-অনিয়ম,টেন্ডারবাজি, চাকরিবাণিজ্য ও অপরাজনীতি নিয়ে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, ‘নোয়াখালীতে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার হয়েছে। যারা কাজ পেয়েছে, তাদের রিমান্ডে আনেন। কত টাকা তাদের কাছ থেকে নিয়েছে? একটা কাজেরও মান নাই'। তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করে কাদের মির্জা বলেছেন, ‘আমার পরিবারকে হত্যা ও উচ্ছেদ করার জন্য একরাম চৌধুরী ৫০ কোটি টাকার ফান্ড তৈরি করছেন'। কী ভয়াবহ কথা!
সংবাদ সম্মেলন যাতে করতে না পারেন, সে জন্য গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের দিয়ে তাকে ধমক দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে কাদের মির্জা বলেছেন, যেভাবে ষড়যন্ত্র চলছে, তাতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দলের কোনো পর্যায়ে বলে লাভ হয় না বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা ব্যক্ত করে কাদের মির্জা বলেছেন, ‘সরকারি কিছু কর্মকর্তা লুটপাট করে খাচ্ছে দেশটাকে। এটা শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটা শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ পারবে না'। সরকারকে উদ্দেশ্য করে কাদের মির্জা বলেছেন, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করার দরকার, সেগুলো অবশ্যই করতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একজন জেলা পর্যায়ের নেতা, একটি পৌরসভার মেয়র কেন এভাবে ফুঁসে উঠলেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মুখরোচক আলোচনা চললেও বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটাতে দল বা সরকারের মধ্যে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। কেউ কেউ এমন প্রশ্নও করছেন যে, কাদের মির্জা দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাই বলেই কি তিনি শৃঙ্খলাবিরোধী বক্তব্য দিতে পারছেন? আর কেউ এভাবে বললে কি তাকে ছাড় দেওয়া হতো?
কোনো ধরনের খারাপ কাজের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত হলে তাকে বহিরাগত বা অন্য দল থেকে আসা ‘হাইব্রিড' বলে এক ধরনের তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে দেখা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের বড় শত্রু হিসেবে যাদের শনাক্ত করা হয়, তারা আওয়ামী লীগের ভেতরেই বেড়ে উঠেছেন। খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে ড. কামাল– কেউ কিন্তু হাইব্রিড বা কাউয়া ছিলেন না। খন্দকার মোশতাক সবাইকে জানিয়েই দলের নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধে কাজ করতেন। কিন্তু তাকে দল প্রশ্রয় দিয়েছে। পরিণতি হয়েছে ভয়ঙ্কর।
ওবায়দুল কাদেরের ভাই বসুরহাটের কাদের মির্জা জাতীয় পর্যায়ের নেতা না হয়েও যেভাবে মিডিয়ার মনোযোগ পেয়েছেন, তা খুব স্বাভাবিক নয়। দলের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করার বড় ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি কারো মদদে মাঠে নেমেছেন, নাকি এটা সত্যি তার বিবেকের লড়াই তা পরিষ্কার হওয়া দরকার। তার ব্যাপারে সরকার এবং দলের অবস্থান পরিষ্কার না হলে যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হবে তা কিন্তু সত্যি বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। আওয়ামী লীগে কি এমন কেউ নেই যিনি বলতে পারেন, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না ! নাকি আব্দুল কাদের মির্জাই সেই নেতা এবং ত্রাতা ?
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম