বাংলা আমার তৃষ্ণার জল

আমাকে বাংলা বর্ণমালা শিখিয়েছিলেন আমার নানি আয়েশা বেগম। তিনি ছিলেন একজন বিদুষী নারী। শুনেছি আমার আম্মা যখন শিক্ষকতা করতে স্কুলে যেতেন তখন আমার নানি আমাকে নিয়ে পড়তে বসতেন। মজার মজার সব গল্প বলতেন। আমাকে বাংলা বর্ণমালার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
আয়েশা বেগম জন্মেছিলেন আহসান মঞ্জিলের পাশে। তিনি ঢাকার ইডেন স্কুলে পড়তেন। সে সময় স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়। তিনি আমার নানা মতিয়ার রহমানের হাত ধরে চলে আসেন একেবারে অজোপাড়াগাঁয়ে। যশোরের নড়াইলে।
নানির বাংলার দখল ছিল অসাধারণ। নড়াইলে বাড়ির এক কোণায় তার একটি পাঠাগার ছিল। সেখানে থাকত নানা ধরনের বই। তার ঘরের জানালার পাশে টেবিলে বসে নানির রুমের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতাম। বই পড়ার নেশা সেই তখন থেকে। জানালার পাশে বসে পুকুরের দিকে তাকিয়ে নানির গ্রামোফোনে গান শোনা ছিল আমার ছোটবেলার প্রিয় স্মৃতিগুলোর একটি।
আমার নানা মতিয়ার রহমানের পরিবার কলকাতার কাছাকাছি ঈসাপুর থেকে নড়াইলে এসেছিলেন দেশভাগের আগে। নানার পড়াশোনাতে মন ছিল না। তাদের রেসের ঘোড়ার প্রতি ছিল তার ব্যাপক আগ্রহ। তার বাবা তাকে বললেন ঘোড়ার ঘাস কাটবার জন্য। তিনি ঘাস কাটতে যেয়ে হাত কেটে ফেলেন। তখন তার বোধগম্য হলো যে পড়াশুনা করাটা ঘাস কাটার চেয়ে সহজ ব্যাপার।
তিনি সংস্কৃত এবং অংকে ডিস্টিংকশন্সসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঈসাপুর গান ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করলেন। বাবা ইন্তেকাল করার পর কাজ করা ছাড়া তার আর কিছু উপায় ছিল না। তার বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, আররি আর ফার্সিতে ভালো দখল ছিল। তিনি অনেক কিছু বাংলায় তর্জমা করতেন। মসজিদের ইমাম আসতেন কোরআনের অর্থ নিয়ে তার সাথে আলাপ করতে।
আবার পুরোহিত আসতেন বেদের অর্থ নিয়ে তার সাথে কথা বলতে। যখনই আমি নড়াইলে বেড়াতে যেতাম তিনি আমাকে শুদ্ধ বাংলা পড়াতেন। সংস্কৃত শেখাতে চাইতেন। আমি তাকে ছেড়ে তখন পালাতে চাইতাম। তিনি তখন আমাকে ফেরদৌসীর শাহনামার গল্প শোনাতেন। আমি অবাক বিস্ময়ে সেসব শুনতাম।
আমার আব্বার বাংলা ব্যাকরণ এবং সাহিত্যের দখল ঈর্ষণীয়। এ বয়সে অনেক রোগেভুগেও অবিরাম কবিতার পর কবিতা আউড়ে যান তিনি অনায়াসে। প্রিয় লেখকের প্রিয় গল্পের লাইনগুলো এখনো বলে যান সাবলীলভাবে তিনি। আব্বা আমার অনুপ্রেরণা।
আমার আম্মা স্কুলে ছাত্রদের বাংলা পড়াতেন। আজন্ম প্রকৃতিপ্রেমী আমার আম্মা অসাধারণভাবে আমার মনে দাগ কেটেছেন সেই ছোটবেলা থেকে।
নদীপথে ভ্রমণের সময়, কাশবনের পাশে, বর্ষণমুখর রাতে, ধান ক্ষেতের পাশে, গ্রামের বাড়ির উঠোনে বসে আমার আম্মা আমাকে বলতেন এসব নিয়ে লেখো।
আমি যখন বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখি বা বাংলায় স্বপ্ন দেখি, তখন আমার শেকড় আঁকড়ে ধরি আমি। আমার নানা-নানি, দাদা-দাদি, আব্বা-আম্মাকে দেখি তাতে। বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও বাংলা সাহিত্য, গান, কবিতায় আমি উদ্বেলিত হই। আমি জীবন খুঁজে পাই বাংলাতে। আর তাইতো বলি, বাংলা আমার তৃষ্ণার জল।
এইচআর/এমএস