চীনে অমিক্রনের নতুন টিকা

চীনের উহানে ২০১৯ সালের শেষ দিকে মহামারি দেখে দেওয়ার পর প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে। এ দীর্ঘ সময়ে আমাকে কখনও কোভিড টেস্ট করাতে হয়নি। এর একাধিক কারণ আছে। মহামারি শুরুর পর আমি বেইজিংয়ের বাইরে যাইনি বা যাওয়ার সুযোগ পাইনি। গেলে টেস্ট করাতে হতো, বাধ্যতামূলকভাবে। আবার, আমি বেইজিংয়ের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, সিচিংশান নামক যেই জেলায় থাকি, সেটি এতোদিন বলতে গেলে কোভিডমুক্ত ছিল।
এখন পরিস্থিতি বদলেছে। গত ২৬ এপ্র্রিল আমাকে প্রথম কোভিড টেস্ট করাতে হয়েছে। ম্যাস টেস্ট বা গণপরীক্ষা। বাসার কাছেই অস্থায়ী টেস্ট-সেন্টার। খানিকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা বা স্যাম্পল দিয়ে আসতে হয়। নমুনা মুখ থেকে সংগ্রহ করা হয়। দশ জনের স্যাম্পল একটি টেস্ট টিউবে সংরক্ষণ করেন স্বেচ্ছাসেবকরা। টেস্টও করা হয় একসঙ্গে। এতে অর্থ ও সময়—দুটোই সাশ্রয় হয়। পরের দিন মোবাইল অ্যাপে টেস্টের রেজাল্ট চলে আসে।
টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ আসলে বোঝা যায় যে, ওই দশ জনের শরীরে কোভিড নেই। আর যদি রেজাল্ট পজেটিভ হয়, তখন ওই দশ জনকে আলাদাভাবে আবার টেস্ট করা হয়। টেস্ট করাতে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না। এভাবেই চলছে। ‘চলছে’ বললাম, কারণ ৯ মে পর্যন্ত মোট ৯ বার টেস্ট করিয়ে ফেলেছি। প্রতিবারই নেগেটিভ। আশঙ্কা করছি, আরও টেস্ট করাতে হবে।
রেজাল্ট নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও কেন বার বার টেস্ট করাতে হচ্ছে, সেটা আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা একটু কঠিন বৈকি। তবে এটুকু বুঝি যে, প্রয়োজন আছে বলেই এমনটা করা হচ্ছে। এ ধরনের ম্যাস টেস্টিং, লকডাউন, ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচি, ইত্যাদির মাধ্যমেই তো চীন মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে ও হচ্ছে! এ পদ্ধতি ইতোমধ্যেই কার্যকারিতার পরীক্ষায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছে বলা চলে। তাই, কোটি কোটি চীনার মতো আমিও একের পর এক স্যাম্পল দিয়ে যাচ্ছি এবং মেনে চলছি মহামারি-প্রতিরোধক নিয়মবিধি।
এখন প্রায় প্রতিদিনই গোটা বেইজিংজুড়ে চলছে কোভিডের গণপরীক্ষা। এই গণপরীক্ষার ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য একটি দিনের হিসাব দিই। গত ৭ মে বেইজিংয়ের গণপরীক্ষাকেন্দ্রগুলো মোট স্যাম্পল সংগ্রহ করে এক কোটি ৫৫ লক্ষাধিক মানুষের (বেইজিংয়ের মোট লোকসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি)। এসব স্যাম্পলের নিউক্লিক এসিড টেস্ট করার পর দেখা গেল মাত্র পাঁচটি টিউবের স্যাম্পলে (প্রতি টিউবে দশ জনের স্যাম্পল) ভাইরাস আছে।
বেইজিংজুড়ে এই গণপরীক্ষা চলছে গত ২২ এপ্রিল থেকে। কোটি কোটি স্যাম্পল পরীক্ষার পর, গত ৮ মে পর্যন্ত, মাত্র ৭২৭ জনের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এই ৭২৭ জনের মধ্যে ৬৮৬ জন আগেই কোভিডের টিকা নিয়েছেন। আবার ৬৮৬ জনের মধ্যে ৫৮৮ জন অন্তত দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন এবং তাদের লক্ষণ তেমন মারাত্মক নয়।
আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনা করলে বলতেই হবে যে, বেইজিংয়ের অবস্থা তেমন একটা খারাপ নয়; অন্তত শাংহাইয়ের চেয়ে অনেক ভালো। গত ৮ মে গোটা চীনে মোট ৪০১ জন লক্ষণযুক্ত কোভিড রোগী শনাক্ত হন, যাদের ৩২২ জনই শাংহাইয়ের; বাকিরা বেইজিংসহ ৬টি প্রদেশের। সেদিন বেইজিংয়ে রোগী শনাক্ত হয় ৩৩ জন। তাছাড়া, ৮ মে চীনে কোভিডে মারা গেছেন যে ১১ জন, তাদের সবাই শাংহাইয়ের বাসিন্দা।
উহানে দেখা দেওয়ার মাস চারেকের মধ্যেই চীন কোভিড মহামারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর প্রায় দুই বছর চীনে কোভিডে কেউ মারা যায়নি। এই দুই বছরে চীনে কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ায়নি, মৃতের সংখ্যাও ছাড়ায়নি ৫ হাজারের কোঠা। কিন্তু বিগত কয়েক সপ্তাহে চীনে মহামারী পরিস্থিতির আকস্মিক অবনতি ঘটে। ৯ মে প্রকাশিত সরকারি হিসাব অনুসারে, চীনের মূল ভূভাগে শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা এখন দুই লাখ বিশ হাজারের বেশি; মৃতের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,১৮৫ জনে। তবে, এখনও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বহু দেশের সঙ্গে চীনের তুলনাই চলে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুসারে, চলতি বছরের ২ মে পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্রে শনাক্ত কোভিড রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ৮ কোটি সাড়ে ৮ লাখের ওপরে। এদের মধ্যে মারা গেছেন ৯৮৯,৪৩৫ জন। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে কোভিডে মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে পরের তিনটি স্থান দখল করে আছে যুক্তরাজ্য (১৭৫,৯৮৪ জন), ইটালি (১৬৪,১৭৯ জন), ও ফ্রান্স (১৪৩,২৪৯ জন)।
সম্প্রতি গোটা বিশ্বসহ চীনের মহামারি পরিস্থিতির নতুন করে অবনতি ঘটিয়েছে অমিক্রন। গ্রিক বর্ণমালার ১৫তম বর্ণ অমিক্রন (Omicron)। এই নিরীহ বর্ণটির সঠিক ইংরেজি উচ্চারণ আসলে ‘অম্যাক্রন’। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম একে ‘অমিক্রন’‘ওমিক্রন’ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। যাই হোক, করোনাভাইরাসের সম্পূর্ণ নতুন ভ্যারিয়েন্ট বি.১.১.৫২৯-কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর ‘অমিক্রন’ নাম দেয়। এক্ষেত্রে হু গ্রিক বর্ণমালার পূর্ববর্তী দুটি বর্ণ ‘নিউ’ (nu) ও ‘সি’ (xi)-কে বিবেচনায় রাখেনি। কারণ, প্রথমটি লোকজন ইংরেজি নিউ (new) শব্দের সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারে এবং দ্বিতীয়টি চীনে মানুষের বংশগত নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টকে আলাদা নাম দিতে হয়েছে, কারণ এটির প্রকৃতি মিউটেশানের কারণে বদলে গেছে আমূল। অমিক্রন আসার আগে বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে ডেল্টা (ডেল্টা গ্রিক বর্ণমালার চতুর্থ বর্ণ) ভ্যারিয়েন্ট। অমিক্রন ডেল্টার মতো মারাত্মক নয়, তবে এর সংক্রমণ-ক্ষমতা খুবই বেশি। অন্যভাবে বললে এটি খুব দ্রুত ছড়ায়। তাছাড়া, মানুষের ফুসফুসে ঢুকে এটি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে প্রায় ৭০ গুণ বেশি দ্রুত বাড়তে পারে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এই ওমিক্রনের তাণ্ডবই চলছে। সেই তাণ্ডবের ছোঁয়া এসে লেগেছে চীনেও। তিন তিন ডোজ টিকা নিয়েও তাই আমার মতো কোটি কোটি মানুষকে ঘন ঘন কোভিড টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
অমিক্রন প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর, দক্ষিণ আফ্রিকায়। এরপর থেকে এটি বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্টের অন্তত পাঁচটি সাব-টাইপও শনাক্ত হয়েছে। হু হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, অদূর ভবিষ্যতে আরও নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখা যেতে পারে। তবে, এই মুহূর্তে মাথাব্যথার কারণ এই অমিক্রন। করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে প্রচলিত কোভিড টিকাগুলো অনেককেই রক্ষা করতে পারছে না, এটা বোঝাই যাচ্ছে। তবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা ফুল ডোজ প্রচলিত টিকা নিয়েছেন, তারা অমিক্রনে আক্রান্ত হলেও, তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার খুবই কম। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানিরা প্রচলিত টিকা যারা এখনও নেননি, বা ডোজ পূর্ণ করেননি, তাদেরকে দ্রুত টিকা নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন।
চীনা বিজ্ঞানীরাও একই কথা বলছেন। পাশাপাশি, তারা অমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকর নতুন ধরনের দুটি টিকাও আবিষ্কার করেছেন। এই দুটি টিকা তৈরি করেছে চীনের সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাক বায়োটেক নামক দুটি কোম্পানি। সম্প্রতি এই দুটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে চীনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। হংকংয়ে এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে আরও আগে, ১৩ এপ্রিল। এখন চীনের মূল ভূভাগেও ট্রায়াল শুরু হলো।
ইতোমধ্যেই চীনের প্রায় ১২০ কোটি নাগরিক ফুল ডোজ টিকা নিয়েছেন। এখন অমিক্রনের নতুন টিকা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তা বুস্টার ডোজ হিসেবে নাগরিকদের দেওয়া হবে। মাত্র গত ডিসেম্বরে চীনা বিজ্ঞানীরা এই নতুন টিকা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। প্রাক-ক্লিনিক্যাল গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল ও পশুদের ওপর টিকার কার্যকারিতার পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে, নতুন দুটি টিকা মানুষের শরীরে অমিক্রন ও অন্য একাধিক করোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্টের কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম।
শুধু চীনেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও অমিক্রমনের বিশেষ টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে। দেশটির ফাইজার ও মডার্না কোম্পানি একাধিক টিকা নিয়ে কাজ করছে। ফাইজারের সিইও আলবার্ট বুরলা সম্প্রতি এবিসি নিউজকে বলেছেন, খুব শিগগিরই অমিক্রনের টিকা বাজারে আসবে। এদিকে, চীনের টিকা উন্নয়ন টাস্ক ফোর্সের প্রধান চ্যং চুংওয়েইও একই আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে অমিক্রনের দুটি নয়, বরং তিনটি স্থায়ীভাবে উৎপাদিত টিকা বাজারে পাওয়া যাবে।
অমিক্রনের টিকা যে খুব শিগগিরই বাজারে আসবে এবং বেঁচে থাকলে আমার মতো কোটি কোটি মানুষ তা পাবেনও, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে: ভাইরাস ও টিকার এই দ্বৈরথ আর কতো কাল স্থায়ী হবে? কবে শেষ হবে মহামারি? নাকি অমিক্রনের পর আসবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো করোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট, যার নামকরণ করা হবে ‘সিগমা’ বা গ্রিক বর্ণমালার অন্য কোনো বর্ণের নামে?
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
[email protected]
এইচআর/এমএস