কোভিড রোগের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি কতটুকু কার্যকর?
ডা. খন্দকার এম আকরাম
বাংলাদেশে বেশ কয়েকদিন হলো করোনা রোগীদের কনভালেসেন্ট প্লাজমা দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। মিডিয়াতে প্লাজমা থেরাপি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়ে গেছে। আশার কথা হলো বাংলাদেশেও সম্প্রতি করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির ফেইজ টু (Phase II) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হয়েছে। আমার পুরো খবরটা জানা নেই, তবে আশা করছি এই ট্রায়ালে সঠিকভাবে প্লাসিবো কন্ট্রোল রাখা হবে।
করোনা চিকিৎসায় যেখানে নতুন নতুন ড্রাগ ট্রায়াল তেমন কোনো সুখবর দিতে পারছে না, সেখানে সবাই এখন প্লাজমা থেরাপির দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমারও আগ্রহ এবং কৌতুহল কম নয়! তবে একজন চিকিৎসক এবং বায়োমেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ একটু আলাদা। একজন সায়েন্টিস্ট হিসেবে আমি জানতে চাই, কেন কনভালেসেন্ট প্লাজমা করোনা চিকিৎসায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটা কী। আর একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি দেখতে চাই ‘এভিডেন্স’, যে প্রকৃতভাবেই প্লাজমা থেরাপি করোনা রোগে কার্যকর কি-না।
কনভালেসেন্ট প্লাজমা হলো রক্তের কোষবিহীন হলদে রঙের জলীয় অংশ, যা করোনা অথবা অন্যান্য ভাইরাস ইনফেকশন থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের শরীর থেকে নেয়া হয়। একজন মানুষ যখন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন তার শরীরের ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় হয়ে উঠে। এক থেকে দুই সপ্তাহের ভেতরেই রক্তে থাকা বি-লিম্ফোসাইট কোষগুলো এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন তৈরি করতে শুরু করে, যা ইমিউনোগ্লোবিউলিন (IgG এবং IgM) বা অ্যান্টিবডি নামে পরিচিত। ইনফেকশনের পরে রক্তের এই পরিবর্তনকে বলা হয় ‘সেরোকনভার্সন’- এটা একটা ন্যাচারাল রোগ-প্রতিরোধক প্রক্রিয়া। করোনা ইনফেকশনের ক্ষেত্রে এই সেরোকনভার্সন হতে সময় লাগে ৭ দিন (IgG) থেকে ১৪ দিন (IgM), এবং ২১ থেকে ২৮ দিনের ভেতরেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। করোনা আক্রান্ত রোগীর শরীরে যখন এই পরিবর্তনটি হয়, তখন বলা হয় যে আক্রান্ত ব্যাক্তিটি করোনার বিরুদ্ধে ইমিউনিটি ডেভেলপ করেছে। গবেষণায় দেখা যায় যে, রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই শরীর থেকে করোনাভাইরাসটি নির্মূল হতে শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত হওয়ার ১৪ দিনের ভেতরেই শরীরের সব ভাইরাস নির্মূল হয়ে যায়।
অনেক ধরনের করোনাভাইরাস রয়েছে। তার ভেতরে নতুন ধরনের SARS-Cov-2 করোনাভাইরাসের সংক্রমণেই কোভিড-১৯ রোগটি হয়ে থাকে। ২৬ মে নেচার জার্নালে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এখানে গবেষকরা ৮ জন করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীর রক্তের বি-লিম্ফোসাইট পরীক্ষা করে প্রায় ২০৬ ধরনের অ্যান্টিবডির সন্ধান পান। আর এ সব অ্যান্টিবডি পরীক্ষাগারে SARS-Cov-2 করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম বলে দেখা গেছে। মজার ব্যাপার হলো এই অ্যান্টিবডিগুলো কিন্তু অন্য করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে না। এই একই ধরনের ফলাফল তারা দেখতে পান যখন তারা ওই রোগীদের কাছ থেকে রক্তের সেরাম বা প্লাজমা নিয়ে পরীক্ষাগারে করোনাভাইরাসের ওপর প্রয়োগ করেন। এ দুটো ল্যাবরেটরি পরীক্ষা থেকে এটা বোঝা যায় যে করোনা ইনফেকশনে মানুষের রক্তে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম। প্লাজমা থেরাপির পক্ষে এটা হল নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।
কিন্তু চিকিৎসার জন্য দরকার ‘এভিডেন্স’। এটা কি আমাদের হাতে আছে?
এপ্রিলের শুরুর দিকে নামকরা জার্নাল পিএনএএস-এ একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এটা ঠিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিষয় নয়। চীনের ১০ জন আইসিইউতে ভর্তি হওয়া মারাত্মকভাবে কোভিডে আক্রান্ত রোগীর দেহে ২০০ মিলিলিটার করে কনভালেসেন্ট প্লাজমা প্রয়োগ করা হয়। রোগীদের ওপর এই প্লাজমা থেরাপি শুরু করা হয় আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ১৫ দিন পর। প্লাজমা থেরাপির ৩-৭ দিনের ভেতরে সকল রোগীরই অবস্থার উন্নতি ঘটে। চিকিৎসার শুরুতে ১০ জনের মধ্যে ৭ জনের ভাইরেমিয়া (রক্তে ভাইরাস) ছিল, প্লাজমা থেরাপির পরপরই রক্তের ওই করোনাভাইরাস নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সবারই রক্তের সিআরপি লেভেল কমে আসে এবং লিম্ফোসাইটোপেনিয়াও নরমাল হতে শুরু করে। প্লাজমা থেরাপিতে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু সমস্যা হলো, ওপরের ১০ জন রোগীর সবাইকেই প্লাজমা থেরাপির পাশাপাশি অ্যান্টিভাইরাল, স্টেরয়েড এবং ব্রডস্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি চালানো হয়েছে। সুতরাং রোগীরা কি প্লাজমা থেরাপিতে ভালো হয়েছে নাকি ওষুধে ভালো হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
অন্যদিকে, এপ্রিলের শেষে আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে ছয়জন গুরুতর আক্রান্ত কোভিড রোগীকে কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে থেরাপি শুরু করা হয় আক্রান্ত হওয়ার ২১ দিন পর। থেরাপি দেয়ার পর ছয়জনের ভেতরে পাঁচজনই মারা যায়। আর কন্ট্রোল গ্রুপের (যাদের প্লাজমা দেয়া হয়নি) ১৫ জনের ভেতরে মারা যায় ১৪ জন। থেরাপি গ্রুপ এবং কন্ট্রোল গ্রুপের সকল রোগীকেই অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিবায়োটিক চালানো হয়। এ চিকিৎসাটাও দেয়া হয় চীনের রোগীদের। এটা খুবই ছোট পরিসরে একটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। কিন্তু থেরাপি দেয়ার আগে রোগীদের শারীরিক অবস্থা ছিল সংকোটাপন্ন, সবারই ছিল রেসপিরেটরি ফেইলর।
সুতরাং ওপরের পর্যালোচনা থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসা যায়:
(১) মারাত্মকভাবে আক্রান্ত কোভিড রোগীর চিকিৎসায় শুধু প্লাজমা থেরাপি কতটুকু ফল দেবে তা এখনো বলা যায় না। আর এ কারণে যত্রতত্র করোনা রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেয়া হবে মেডিক্যাল ইথিক্স বহির্ভূত।
(২) সুতরাং প্লাজমা থেরাপি দিতে গেলে অবশ্যই নিয়ম মেনে শুধুমাত্র ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমেই দিতে হবে।
(৩) যদিও প্লাজমা থেরাপি অনেকটাই নিরাপদ, তারপরও প্লাজমা প্রয়োগের আগে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ওই প্লাজমাতে কোনো করোনা, এইচআইভি, ডেঙ্গু বা হেপাটাইটিস ভাইরাস নেই।
(৪) কনভালেসেন্ট প্লাজমা কালেক্ট করতে হবে রোগী সুস্থ হবার কমপক্ষে ২৮ দিন পর, যাতে করে নিশ্চিত করা যায় যে ওই প্লাজমাতে কোনো করোনাভাইরাস নেই। ব্রিটেনের এনএইচএসে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়।
(৫) প্রতিটা প্লাজমার অ্যান্টিবডি টাইটার করা জরুরি। অ্যান্টিবডি টাইটার কমপক্ষে ১:১৬০ হতে হবে। এর নিচে হলে প্লাজমা দিয়ে কী কোন লাভ আছে?
(৬) ৯০-৯৫ ভাগ করোনারোগী আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। সুতরাং প্লাজমা থেরাপি গ্রহীতার ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন ধার্য করতে হবে। কাকে থেরাপি দেয়া হবে আর কাকে দেয়া হবে না, এটা স্থির করতে হবে।
সব শেষে বলবো যে, এখনো আমাদের হাতে এমন কোনো এভিডেন্স নেই, যা দিয়ে বলা যায় যে কনভালেসেন্ট প্লাজমা করোনা রোগ থেকে আরোগ্য দেবে।
লেখক
ডা. খন্দকার এম আকরাম
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি
রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট
ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য
এইচএ/এসআর