পরিবেশ বাঁচাই, সুস্থ থাকি

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:০২ পিএম, ০৫ জুন ২০২০

প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রতি বছর এই দিনটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হলেও এ বছর তেমনটি হচ্ছে না শতাব্দীর ভয়াবহ মহামারি করোনার কারণে। দিবসটি পালনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেই কোনো আড়ম্বরতা। খুব সাদামাটাভাবেই পালিত হচ্ছে দিবসটি। মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আজ গোটা পৃথিবী। চরম সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি। দেশে দেশে শিক্ষা, শিল্প, যোগাযোগ, পর্যটন ব্যবসায়-বাণিজ্য স্থবির। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের পরিস্থিতি তা থেকে মোটেই ভিন্নতর নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অন্য দেশের চেয়ে আরও ভয়ানক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালুর কথা বলা হলেও বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটা।

আমরা শপিংমল খুলে দিলাম কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করলাম না। লকডাউন না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে উৎসবের আমেজ তৈরি করলাম। পরিবহন বন্ধ রেখে গার্মেন্টস খুলে দিলাম। ঈদের পর স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে গণপরিবহন চালু হলো কিন্তু বিধি মানার কোনো বালাই নেই। সদরঘাটে যা হচ্ছে তা তো আরও উদ্বেগজনক। মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের কথা চিন্তা না করে গণপরিবহনের ভাড়া একলাফে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলো। করোনা সংকট কেটে গেলে ভাড়া আগের পর্যায়ে আসবে কিনা তার কোনো সুস্পষ্ট সরকারি ঘোষণা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করলাম কিন্তু মান বজায় রাখতে কোনো তদারকি নেই। সবখানেই সমন্বয়হীনতা প্রকট। দেশে প্রায় ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থাকলেও জাতির এমন দুর্যোগে তাদের অধিকাংশের ভূমিকা স্বাস্থ্যসহায়ক নয়। দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি। সাধারণ রোগে অসুস্থ মানুষের স্বাস্থ্যসেবাও নাগালের বাইরে।

মহামারি করোনা কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, ৫ জুন পর্যন্ত করোনা মহামারিতে বিশ্বে প্রাণ হারিয়েছে তিন লক্ষ ৯৩ হাজার ২১২ জন। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৮১ জন। বিশ্বে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হলো ৬৭ লক্ষ দুই হাজার ৭৯৩ জন। দেশে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৭ হাজার ৫৬৩ জন। বিশ্বের প্রায় ২১৩টি দেশে ছড়িয়েছে মহামারি করোনা। স্থবির করে দিয়েছে জনজীবন। মহামারি কেটে যাওয়ার পর পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতি কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা। এই শতাব্দীর বহুল আলোচিত বিষয় হলো কোভিড-১৯।

বিশ্ব মহামারির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর আগেও ভাইরাস ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে মানবসভ্যতায় সময়ে সময়ে চরম আঘাত করেছে। এসেছে রাশিয়ান ফ্লু, স্প্যানিস ফ্লু, কলেরা, এইডস ও প্লেগের মতো মহামারি। প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। সময়ের ব্যবধানে তা আবার হারিয়েও গেছে।

আজ কথা উঠেছে কেন মহামারিগুলো একের পর এক পৃথিবীতে আবির্ভূত হচ্ছে। প্রকৃতি আমাদের জন্য ধরণীতে অনেক নিয়ামত দিয়েছে। আমরা প্রকৃতির নিয়ামতগুলো ভোগ করছি সত্য কিন্তু এই আমরাই আবার অকৃতজ্ঞের মতো নির্বিচারে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংস করছি। প্রকৃতি আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অকৃত্রিমভাবে আলো-বাতাস, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল দান করেছে। প্রকৃতি আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দুই হাত উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা হিংস্র হায়েনার মতো নিজেদের ভোগবিলাসের জন্য তা ধ্বংস করে দিচ্ছি। আমরা একবারও ভেবে দেখছি না যে প্রকৃতির ক্ষতি করলে প্রকৃতি চুপচাপ বসে নাও থাকবে পারে। প্রতিশোধ নেয়া শুরু করে দিতে পারে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলার চেষ্টা করছেন যে কোভিড-১৯ প্রকৃতির প্রতিশোধ।

সৃষ্টির উষালগ্নে গোটা বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশ ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও মনোমুগ্ধকর। আর এই মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পৃথিবীতে নেমে আসে বিপর্যয়। আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি গ্রিনহাউজ ইফেক্টের কথা। আমরা পাহাড়-পর্বত কেটে ইটভাটা তৈরি করেছি। নদী ও খাল-বিল দখল বা ভরাট করে নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য অট্টালিকা তৈরি করেছি। কারখানার দূষিতবর্জ্যে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালুসহ দেশের অসংখ্য নদীর পানিকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলেছি।

ভাওয়ালের বনসহ দেশের অজস্র বন উজার করে কারখানা তৈরি করেছি। গণদাবি উপেক্ষা করে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির মাধ্যমে প্রকৃতির প্রাচীর সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছি। অথচ এই সুন্দরবনই বারবার সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় বুক চিতিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে। আজ মনুষ্য অত্যাচারে বিপন্ন সেই সুন্দরবন। অপরিকল্পিত নগরায়ন করতে গিয়ে উজাড় করে ফেলেছি ফসলের জমি। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় দূষিত বায়ু। শহুরে জীবনে শব্দদূষণের মাত্রা পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়া বিষাক্ত করে তুলছে জীবন বাঁচানোর জন্য গ্রহণ করা বায়ুকে। অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, জীববৈচিত্র্য ও জীবজন্তু নিধন করার কারণে বিশ্ব পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত।

যে জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি আমাদের জন্য সেই প্রকৃতিকেই আমরা নির্বিচারে ধ্বংস করছি। প্রকৃতি অত্যাচারিত হতে হতে আজ মনে হয় নিজেই প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নিতে শুরু করে দিয়েছে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আমরা সবুজ-শ্যামল গ্রামকে বানিয়েছি এক একটি বিবর্ণ উন্নতবস্তি। যেখানে নেই সবুজ। অনুপস্থিত পাখিদের কলতান। বড় বড় শহরকে বানিয়েছি ইট-পাথরের একেকটি জঙ্গল। যে জঙ্গলে জন্ম নেয় ডেঙ্গুর লাভা।

এদিকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত গলে যাচ্ছে বরফ। বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগরে তলিয়ে যাবার ঝুঁকিতে রয়েছে সাগরতীরবর্তী অঞ্চল। শিল্পায়নের কারণে বাতাসে কার্বণের মাত্রা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের অক্সিজেন খ্যাত আমাজন বন আজ রুগ্ন।

মানবসভ্যতার অস্তিত্ব টিকে রাখতে বিশ্বজলবায়ুর বিপর্যয় রোধ করা এবং পরিবেশ টিকিয়ে রাখা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্পপথ খোলা নেই। দিনের পর দিন মনুষ্যসৃষ্ট অত্যাচার-অবিচারের কারণে নদীগুলো হয় মরে গেছে, নয় তো দখলে তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। একরের পর এক বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশের জীববৈচিত্র্য। পরিবেশকে দূষণ করেছি ইচ্ছেমতো। পরিবেশ ধ্বংস করলেও তা বাঁচানোর দায়িত্ব আমরা পালন করতে পারিনি। কী রেখে যাচ্ছি আগামী প্রজন্মের জন্য। আসুন পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাই, এক টুকরো সবুজের ছোঁয়া দেই আমাদের সন্তানদের। গ্রামকে ফিরে নিয়ে যাই গ্রামের আদলে। ইটপাথরে গড়া বিবর্ণ শহরগুলোকে গড়ে তুলি বাসযোগ্য একেকটি সবুজ নগরে। যেখানে থাকবে অগণিত গাছ। কার্বনমুক্ত নির্মল বায়ু।

কেউ কেউ আবার করোনাকে প্রকৃতির আশীর্বাদ হিসেবে দেখছে। করোনায় রং বদলিছে প্রকৃতি। বহুদিন পর কক্সবাজার সমুদ্রের লোনাজ্বলে ডলফিন জলকেলি করছে। সৈকতের তপ্ত বালুতে লাল কাঁকড়া দলবেঁধে দৌড়াচ্ছে। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যাণে পাখিদের কলতান বৃদ্ধি পেয়েছে। শব্দদূষণ কমে গেছে। বায়ুদূষণ নেই বললেই চলে। ঢাকার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে বুক আর ভারী হয়ে ওঠে না। রাস্তাঘাটে কোলাহল কমেছে। প্রকৃতি ছেয়ে গেছে সবুজে। আসুন আমরা পরিবেশ বাঁচাই, বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এটা কোনো স্লোগান নয়, সময়ের দাবি।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মধ্য দিয়ে আজ লেখাটার পরিসমাপ্তি করতে চাই। কবি বলেছেন- এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে, আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ।

লেখক : প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

এইচআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।