কেউ যেন সুযোগ নিতে না পারে

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২২ পিএম, ১৪ জুন ২০২০

মনিরা নাজমী জাহান

করোনা এক ভয়াবহ বিভীষিকার নাম। পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে করোনাভাইরাস আক্রমণ করেনি। সারা পৃথিবীতে মহামারি আকার ধারণ করেছে এই ভাইরাস। পৃথিবীর ২১৩ দেশের প্রায় ৮০ লাখ লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিদিন বহু মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এই অদৃশ্য ভাইরাস। গত ১০০ বছরের ইতিহাসে কোনো ব্যাধির কাছে মানবজাতির এমন করুণ পরিণতির উদাহরণ বিরল।

করোনা মহামারির কারণে মূলত দুটি ধাপে মানুষের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি হবার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। একটি করোনা মহামারি চলাকালীন এবং অপরটি করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে। করোনা চলাকালীন সৃষ্ট সমস্যাগুলো ইতোমধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই সমস্যাগুলো বিশ্ব রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক এমনকি ব্যক্তিজীবনকেও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি বিশ্বের দুই পরাশক্তির পরস্পরকে দোষারোপের লড়াই।

দেখেছি ধর্মের ভিত্তিতে মহামারিকে কেন্দ্র করে একে অপরকে দোষারোপের লড়াই। সামাজিক অবক্ষয়ের এক বীভৎস রূপ দেখেছি এই করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে। কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে শুনলে তাকে সমাজচ্যুত করার এক বীভৎস লড়াইয়ে মেতে উঠেছে সমাজ। ব্যক্তিজীবনে করোনা মহামারির প্রভাব কোনো অংশে কম ভয়াবহ নয়। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা- ইউএনএফপিএ এবং এভেনার হেলথ, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশে গত তিন মাসের লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা ২০ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রতিবেদন থেকেই বোঝা যায় করোনা মহামারিতে মানুষের ব্যক্তিজীবনও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এবার আসা যাক করোনা পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত বিপর্যয় নেমে আসতে পারে তার একটি হলো অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডি হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় যে বিরাট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা পরবর্তী বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর অর্থবাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এবারের আঘাত তার চেয়েও অনেক আকস্মিক। এই অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বিশ্বে প্রবৃদ্ধির হার হবে নিম্নমুখী। যার ফলে প্রচুর মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে, প্রভাব পড়বে বৃহৎ শিল্প কারখানাতেও। ফলশ্রুতিতে প্রচুর বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। সামাজিক অস্থিরতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে।

করোনাপরবর্তী সময়ে বিশ্ব আরেকটি ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হবে খাদ্যকে কেন্দ্র করে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ‘ডব্লিউএফপি’র প্রধান ডেভিড বসেলে বলেছেন, করোনা সংকটের কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট ধেয়ে আসছে তা খুবই ভয়াবহ। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ বিশ্বের গরিব জনগোষ্ঠির মুখে খাদ্য তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। এসব গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ব-ব্যবস্থার আওতায় একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতিসংঘ তহবিল গঠন করা না হলে এ ভয়াবহ পরিণতি মেনে নিতে হবে বিশ্ববাসীকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন দেশের আর্থিক সহায়তায় বিশ্বের অন্তত ১০ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয় ডব্লিউএফপি। এর মধ্যে কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ খাবার না পেলে অনাহারে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। তবে এত সমস্যার মধ্যেও নতুন আরেকটি সমস্যা বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। সেই সমস্যাটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ। করোনা মহামারি চলাকালীন এবং করোনা পরবর্তী সময়ে যে কয়টি প্রধানতম সমস্যা বিশ্ববাসীকে মোকাবিলা করতে হবে সেই সমস্যাগুলকে জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়ার কাজে ব্যবহার করার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। করোনাকালে জাতীয়তার ভিত্তিতে বা ধর্মের ভিত্তিতে যেভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে যেভাবে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে তা সত্যিই ভয়াবহ। এই ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানোর সুযোগ নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী খুব সহজেই জঙ্গিবাদকে উস্কে দিতে পারে।

সম্প্রতি এমন নজির লক্ষ করা গেছে আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডে। আল-কায়েদা বলেছে, অমুসলিমরা তাদের এই কোয়ারেন্টাইনের সময়টাতে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে। ইসলামিক স্টেট অবশ্য কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছে। অনুসারীদের কোনো অনুকম্পা না দেখিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছে তারা। মহামারি শুরুর দিকে নিজেদের ম্যাগাজিন আল নাবাতে কোভিড-১৯’কে খ্রিস্টান দেশগুলোর জন্য সাজা হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণা চালিয়েছিল আইএস। করোনা নিয়ে বেসামাল থাকা পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালাতে অনুসারীদের আহ্বান জানিয়েছিল তারা।

সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতে করোনা পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাস্তিকতা ও অনৈতিকতার যে জোয়ার চলছে তার শাস্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী এ মহামারি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে আরেকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা কোভিড-১৯ নিয়ে ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, ‘করোনা গোটা দুনিয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, যন্ত্রণাদায়ক ছায়া ফেললেও মুসলিম বিশ্বে ভাইরাসটি প্রবেশ করার কারণ হলো মুসলিম দেশগুলোতে পাপ, অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। তারা বলছে, ‘সঠিক ধর্মবিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানাতে এবং দমন ও দমনকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে করোনা সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।’

জার্মান সাংবাদিক Souad Mekhennet দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে এ বিষয়ে লিখেছেন। Far-right and radical Islamist groups are exploiting coronavirus turmoil শিরোনামের বিশ্লেষণধর্মী সেই লেখায় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ভাইরাস সম্পর্কে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো শুরু করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তার এই দাবির পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় নাইজেরিয়ার বোকো হারামের এক অডিও বার্তায়। যেখানে দাবি করা হয়, বোকো হারাম যে নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করে সেটাই হলো অ্যান্টিভাইরাস। সেই অডিও বার্তায় সামাজিক দূরত্বের কথা বলে মসজিদ বন্ধ করে দেয়াকে ইসলামের ওপর আঘাত বলে উল্লেখ করেছে বোকো হারাম নেতা আবুবকর শেকাউ।

শুধু জঙ্গি কর্মকাণ্ড নয় কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মহামারি ছড়াতেও জঙ্গিগোষ্ঠীর আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে নিরাপত্তা গবেষক লায়েথ আলখৌরি এপিকে বলেন, এমনকি কোনো কোনো গোষ্ঠী ‘ভাইরাসের হাত থেকে কেবল ধর্ম মানুষকে বাঁচাতে পারে' এমন তত্ত্ব দিয়ে সব বৈজ্ঞানিক সমাধান এড়িয়ে চলার কথা বলে বরং মহামারি ছড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে৷

এ কথা পরিষ্কার যে মহামারিতে বিশ্বজুড়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার পূর্ণ চেষ্টা চালাচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। তাই করোনা পরবর্তী সময়ে যেসব সমস্যা তথা অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্যাভাব ঘিরে যে কঠিন সময় অতিক্রম করতে হবে বিশ্বকে সেই সময়েও পরিপূর্ণভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে এই জঙ্গিগোষ্ঠী। স্বভাবতই মানুষ অর্থনৈতিক মন্দা বা খাদ্য সংকটকে ঘিরে কিছুটা হতাশায় নিমজ্জিত হবে। সেই হতাশাকে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘৃণায় রূপান্তরের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণাই মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে আগ্রহী করে তোলে।

মহামারিতে জঙ্গিগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমন সতর্কবার্তা দিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়টিতে সুযোগ নিয়ে বড় রকমের হামলা চালাতে পারে জঙ্গিরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মতো উদ্বেগ জানায় ব্রাসেলসভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়, কোভিড-১৯ দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা ও আইএসআইএসের বিরুদ্ধে সহযোগিতার জায়গাগুলোকে দুর্বল করে দেবে। এতে এই জঙ্গিরা তাদের অভূতপূর্ব হামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে।''

এ কথা অনস্বীকার্য যে করোনা মহামারিতে জঙ্গিগোষ্ঠী যেমনভাবে সক্রিয় মহামারি পরবর্তী সময়ও তারা ঠিক তেমনভাবেই সক্রিয় থাকবে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। তাই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই মহামারি এবং মহামারি পরবর্তী সময়ে শিথিলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই বরং তাদের আরও কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে জাতে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী বিন্দুমাত্র সুযোগ নিতে না পারে।

লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।