অর্থনীতির চাকায় দরিদ্র পিষ্ট হলে সে দায় কার?

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:০৫ পিএম, ৩০ জুন ২০২০

মো. আরিফুল ইসলাম

সারাবিশ্বে করোনা মহামারির তাণ্ডব। দুমড়ে-মুচড়ে গেছে প্রত্যহিক জীবনের কার্যপ্রণালী। সংক্রমণ আর মৃত্যু বেড়েই চলেছে, অন্ধকারের বুকচিরে প্রবেশ করছি ঘোর অন্ধকারে! জনজীবন স্থবির হয়ে অনেকটাই প্যারালাইসিসে আক্রান্তের মতো থেমে আছে। কিন্তু শ্রমকলের চাকা থেমে নেই, শ্রমিক কাজ করে চলেছে উদয়স্ত। কৃষকের উৎপাদন বন্ধ নেই, লাঙল মেরে, রোদে পুড়ে ফসল উৎপাদনে তারা ক্লান্ত হন না কখনোই।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিক কাজ করে পণ্য উৎপাদন করে যৎসামান্য মূল্য পেয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। অথচ সেই পণ্য বিক্রি করে আরও কয়েকটি শ্রমকলের মালিক বনে যাচ্ছেন চার দেয়ালের সুরক্ষাব্যূহ থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইস ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সে নির্দেশনা দেয়া মালিকশ্রেণি। আবার সেই একই পণ্য রফতানি করে সরকার বলছে আমরা এত এত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছি।

কৃষক সর্বস্ব বিনিয়োগ করে চাষ করে ফসল উৎপাদন করছে। নামমাত্র মূল্যে তাদের থেকে ফসল কিনে চড়া দামে বিক্রি করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। আবার সেই ফসলের বড়াই করেই সরকার বলছে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সত্যজিৎ রায়ের তেতাল্লিশের মন্বন্তর অবলম্বনে 'অশনিসংকেত' চলচ্চিত্রটির কথা মনে পড়ছে; চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চক্রবর্তী বলছিলেন, 'কৃষক লাঙল মেরে ফসল উৎপাদন করে আর আমরা তার ঘাড়ের ওপর বসে খেয়ে যাই'। যাই হোক, এর বিস্তর বর্ণনায় যাব না।

তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানান দিয়েছে, মহামারি করোনার শনাক্তকরণ পরীক্ষা আর সরকারি খরচে হচ্ছে না কারণ কারও আক্রান্ত হওয়া এটা কেবল-ই তার নিজস্ব ব্যাপার। নিজের রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষাও হবে নিজ খরচে। সরকার কেন এর দায়ভার বহন করবে? কথায় যুক্তি রয়েছে নিশ্চয়ই, যেহেতু আহামরি বেশি খরচও নির্ধারণ করা হয়নি।

তবে এক্ষেত্রে খরচ বহন করা উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য হয়তো বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না। সমস্যায় পড়বে একটি শ্রেণি। ওই যারা পণ্য আর ফসল উৎপাদন করে; সেই নিম্নবিত্ত শ্রেণি। যারা এদেশের অর্থনীতির চাকা এখনও সচল রাখতে সেই গাড়ির গাড়োয়ানের ভূমিকা পালন করছে। তারা প্রকাণ্ড মহামারির ঝড়ে ডুবতে যাওয়া অর্থনীতির জাহাজে একেকজন মাঝি সিন্দাবাদ। অথচ সেই অর্থনীতির চাকায়-ই তাদের পিষতে যাচ্ছি আমরা! তাদের প্রতি এতটুকু দায়ভার আমাদের না থাকলে তাদের উৎপাদিত পণ্য রফতানি করে কীভাবে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি! বিশ্ববাজারে সুনাম অর্জন করি! তারা তো পণ্য উৎপাদনে দায়বদ্ধ নয়।

যাদের উৎপাদিত ফসল খেয়ে আমরা বেঁচে আছি, যাদের উৎপাদিত ফসলের জন্য আমাদের বিশ্বের কাছে হাত পাততে হয় না, মাথা উঁচু করে বলতে পারি আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের প্রতি আমাদের দায় নেই?

বলা হয়, ঈশ্বর শ্রমের বিনিময়ে আমাদের কাছে সবকিছু বিক্রি করেছেন তবে কি কোভিড পরীক্ষাটুকু বিক্রি করেও আবার ফিরিয়ে নিলেন! প্রকৃতপক্ষে, কৃষক শ্রমিকেরা আমাদের ওপর সহানুভূতি প্রদর্শন করছে, আমরা দুই হাত পেতে তা গ্রহণ করে আবার ভুলে যাচ্ছি হরদম।

শুধু দায়ই নয় বরং আমরা তাদের কাছে ঋণী। শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য কিংবা মহামারির তাণ্ডবে জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও তারা কথনও বলেনি, আমরা উৎপাদন বন্ধ করে দেব, আমরা ফসল ফলাব না। তাহলে অর্থনীতির চাকায় মরিচা পড়ে যেত! তবে সেটা আমাদের কাছে কাম্যও নয়। সচল থাকবে দরিদ্রদের জীবনের চাকা, সচল থাকবে অর্থনীতির চাকা। সেটি কাম্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।