পাহাড়ে শান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনা

আজ দুই ডিসেম্বর। দিনটি অন্য সাধারণ দিনগুলোর মত হলেও পাহাড়ি তথা পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলার জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ দিন। একই সাথে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন। ১৯৯৭ সালের আজকের দিনে অশান্ত-অস্থির পার্বত্য তিন জেলার দ্বিধা-দ্ব›দ্ব নিরসনে তৎকালীন সরকার কর্র্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে শান্তি চুক্তি করা হয়। যা পরবর্তীতে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পরিচিতি পায়।
শান্তিপূর্ণ ও উন্নত পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠনের লক্ষ্যে অশান্ত-অস্থির পার্বত্য জেলাসমূহকে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিরসন হয়। বন্ধ হয়ে দীর্ঘদিন চলা পার্বত্য অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত। নিজ দেশের অখন্ডতা রক্ষায় শেখ হাসিনার এই চুক্তি ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে অগ্রগণ্য। এই শান্তি চুক্তি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হয় এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সাথে সাথে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিও বৃদ্ধি পায়।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে আধুনিকায়ন কারা লক্ষ্যে বিভিন্ন বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। কিন্তু হতভাগ্য বাঙালি তাঁকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি। তারা হত্যা করেছে বাঙালির সূর্যকে। যে সূর্যের তেজোদীপ্ত আলোয় বাঙালি জাতি পেতো নতুন পথের দিশা।
সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে যখন দেশে ও বিশ্বে নিরন্তর ছুটে চলেছেন জাতির পিতা,ঠিক তখনই দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী,পাকিস্তানী ও অন্যান পরাশক্তির নীল নকশায় হত্যা করা হয় তাঁকে। থমকে যায় স্বাধীন স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ। দেশ চলতে থাকে পাকিস্তানী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ সামরিক যাঁতাকলের প্রকোষ্ঠ থেকে।
এসময় মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু সামরিক সরকার ও পরবর্তীতে নির্বাচিত বিএনপি সরকার এই অঞ্চলে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কোন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে উপনীত হতে চায়নি। বরং তারা সামরিক বাহিনী নিয়োগ করে। এতে হিতে বিপরীত হয়।
শান্তির বিপরীতে বেড়ে যায় অশান্তি। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকতে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। এই সংঘাত বেড়ে যায় পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী নৃগোষ্ঠীর বসবাস ও চাষাবাদের জায়গায় নিয়ে। যেখানে সমতল থেকে বাঙালি নিয়ে স্থায়ী করা। কারণ তখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে নতুন বসতি গড়া বাঙালিদের মধ্যে জমি দখলসহ নানা কারণে বিরোধ হতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা নিজেদের আত্মরক্ষার্থে সংগঠন গড়ে তোলে। যা জনসংহতি সমিতি নাম ধারণ করে। দেশের অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী বা মহল তাদের মদদ দিতে থাকে। এসময়কার সরকার লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ নেয়, যা কার্যকর হয় না। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যাহত হয়। এতে পিছেয়ে পড়ে এই অঞ্চলের মানুষ। প্রায় দুই যুগ ধরে চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন।
১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। উন্নয়নের অচলাবস্থা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়।
এরপর ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউসে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও জনসংহতি সমিতির (জে এস এস) মধ্যে প্রথম বৈঠক হয়। দেশের অখন্ডতা ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ন্যায্য দাবি পূরণের লক্ষ্যে একাধিক বৈঠক হয়। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সপ্তম বৈঠকে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়। শেখ হাসিনার দূরদর্শীতায় দ্রুত সময়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে সক্ষম হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও জনসংহতি সমিতি (জে এস এস)।
এরপর দীর্ঘ পরিক্রমার পর ১৯৯৭ সালের দুই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রি পরিষদ সদস্য, ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিদেশী মিশনসমূহের কূটনৈতিকদের উপস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ্ এবং জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) পক্ষে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি ও শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যা পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। এই শান্তি চুক্তিতে ৭২ টি দফা সন্নিবেশিত হয়।
এরপর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রæয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তিবাহিনীর প্রথম দলটি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। পর্যায়ক্রমে চারধাপে অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়। সর্বশেষ শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে দুদকছড়িতে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন পাস হয়। এবং একই বছরের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। এতে কল্পরঞ্জন চাকমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে (সন্তু লারমা) প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়।
পরবর্তীতে পার্বত্য তিন জেলায় তিনজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পার্বত্য অঞ্চলসমূহের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা দেখভাল করে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩ টি দপ্তর-সংস্থার মধ্যে রাঙামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮ টি হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছ।
এছাড়া পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর ১২ হাজারের বেশি পরিবারকে পুর্নবাসন করা হয়েছে। ২০১০ সালে নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক বিল জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। এছাড়া ২০১৪ সালে সংসদে ১৯৭৬ সালে জারিকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন পাস করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০১৬ সালে সংশোধন করা হয়।
তিন পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ ছিল না সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। যেসব এলাকা দুর্গম সেখানে সৌর বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। যোগাযোগের জন্য রাস্তাঘাটের উন্নয়ন,সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য। এছাড়া আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেজন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক ,ইন্টারনেট সুবিধাসহ অন্যান আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহ সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে শান্তিচুক্তির পর থেকে পার্বত্য অঞ্চল শান্তি ও উন্নয়নের জনপদে পরিণত হয়েছে। বাঙালি এবং পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে মত বিরোধ নয় বরং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টি করার নৈতিক দায়িত্ব সবার উপর বত্যায়। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তি ও অবহেলিত জনপদকে উন্নয়নের ধারায় সংযুক্ত করায় শেখ হাসিনাকে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বলা হয়।
লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এইচআর/জিকেএস