জনগণ আসলেই কার?

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৩:৪০ পিএম, ০৩ অক্টোবর ২০২৫
রহমান মৃধা

৫ আগস্ট ২০২৪—অনেকে বিশ্বাস করেছিলেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট এদিনেই সমাধান হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে—এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক উল্টো। দেশ স্বাধীন হলো না বরং রাষ্ট্র দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো এবং তাকে ভারতে পাঠানো হলো। ফলাফল? একদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আরেকদিকে শেখ হাসিনা—ভারতে থেকেও তার দল ও সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করছেন।

এটি ছিল ভয়াবহ ভুল। তাকে সরানো হলেও সমস্যা থেকে গেলো। প্রশাসন ও দলে অনেকেই এখনো তাকেই নেত্রী হিসেবে মানছে, তাকেই অনুসরণ করছে। এর ফলে শাসনপ্রণালী কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে—এক অংশ চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে, অন্য অংশ চলছে শেখ হাসিনার প্রভাবমুক্ত নয় এমন প্রশাসনের অধীনে। এই দ্বৈত নেতৃত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রকে কার্যত অচল করে দিয়েছে।

অন্যদিকে তারেক রহমান লন্ডন থেকে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে ‌‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আসলে দুই বিদেশি রাজধানী থেকে পরিচালিত হচ্ছে—ভারতের শেখ হাসিনা ও লন্ডনের তারেক রহমান। অথচ দেশের ভেতরে কার্যকর কোনো নেতৃত্ব নেই। বাইরে থেকে নির্দেশ আসছে, কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে সমস্যার সমাধান করার মতো কেউ নেই। তাই বলা যায়—বাংলাদেশ এক ভয়াবহ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

জনগণ কারা?

আমরা সবসময় বলি‘জনগণ এটা চায় না, জনগণ ওটা মেনে নেবে না।’ কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—জনগণ কারা?

• বিএনপি কি জনগণের দল নয়?
• আওয়ামী লীগ, জামায়াত বা অন্য সব দল কি জনগণের অংশ নয়?
• তাহলে দলগুলো বাদ দিলে কে বলতে পারবে—‘আমি জনগণ’?

বাস্তবে খুব অল্প কিছু মানুষই সত্যিকারের ‘জনগণের’ ভূমিকায় থাকে। তারা আছে, কিন্তু ছড়িয়ে–ছিটিয়ে, সংগঠিত নয়। ফলে জনগণ নামটা শুধু কথায় ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। অতীতে হয়নি, আর আমরা চেষ্টা না করলে ভবিষ্যতেও হবে না।

অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিভক্ত সরকার

আজ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ডুবে আছে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট আর চাঁদাবাজিতে। প্রশাসন বিভক্ত—কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে, কেউ শেখ হাসিনার অনুগত। এই পরিস্থিতিতে প্রবাদটিই যথার্থ: ‘হাড়ি ভেঙে দই পড়েছে, বিড়ালের হইছে বাহার।’ সবাই নিজের লাভের জন্য ব্যস্ত, অথচ সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কিছুই জোটে না।

কোথায় ভুল হলো?

• শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হলো, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করা হলো না।
• তাকে ভারতে পাঠানো মানে তার প্রভাব কমানো নয়—বরং দূর থেকে তাকে আরও শক্তিশালী ও রহস্যময় করা হলো।
• একইভাবে তারেক রহমান লন্ডন থেকে দল চালাচ্ছেন—ফলে দেশে নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হয়েছে।
• দুই প্রবাসী নেতা অনলাইনে দল চালাচ্ছেন, আর সাধারণ মানুষ দেশে পড়েছে নেতৃত্বহীন ও বিশৃঙ্খল অবস্থায়।

দেশকে জনগণের করতে কী করা দরকার?

১. জনগণের সক্রিয় উপস্থিতি তৈরি:
রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে টাউন হল, নাগরিক কমিটি ও নিরপেক্ষ মতামত ফোরাম গড়ে তুলতে হবে।

২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ:
ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট ও দুর্নীতির ঘটনাগুলো রেকর্ড ও প্রকাশ করতে হবে। ন্যায়বিচারের জন্য সামাজিক ও আইনি চাপ তৈরি করতে হবে।

৩. ছোট ছোট সেবার মাধ্যমে আস্থা ফিরিয়ে আনা:
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পানি খাতে স্থানীয় উদ্যোগ দেখাতে হবে। এতে জনগণ বুঝবে—কেউ সত্যিই তাদের জন্য কাজ করছে।

৪. স্বচ্ছ নেতৃত্ব ও জবাবদিহি:
জনগণের নামে নয়, জনগণের জন্য রাজনীতি করতে হবে। স্বচ্ছতা ছাড়া আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়।

৫. বাইরের প্রভাবমুক্ত নেতৃত্ব:
ভারত বা লন্ডন থেকে ভার্চুয়াল নেতৃত্বের বদলে স্থানীয়, জনগণকেন্দ্রিক নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। সমাধান আসতে হবে দেশের ভেতর থেকে, বাইরে থেকে নয়।

আজকের বাংলাদেশে বিভক্ত সরকার, দুর্নীতিগ্রস্ত দল, ত্রৈমুখী নেতৃত্ব আর এক অদৃশ্য ‘জনগণ’—সব মিলিয়ে রাষ্ট্র অচল অবস্থায়। শেখ হাসিনা ভারত থেকে প্রভাব চালাচ্ছেন, তারেক রহমান লন্ডন থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আর ভেতরে ছোট দলগুলো আন্দোলন করছে। রাষ্ট্রযন্ত্র ভয়াবহ অস্থিরতায় পড়ে গেছে।

যে দেশে সবাই কোনো না কোনো দলের সমর্থক, যে দেশে ভুল স্বীকারের সংস্কৃতি নেই, অন্যায়ের পর অনুশোচনা নেই, আর ‘জনগণ’-এর নামে দায় চাপানো হয়—সেই দেশ কীভাবে জনগণের হবে?

পরিবর্তন একদিনে হবে না। কিন্তু ছোট ছোট নাগরিক উদ্যোগ, স্বচ্ছ স্থানীয় নেতৃত্ব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান আর জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পথ নেই। আমরা যদি চেষ্টা না করি, তবে ‘জনগণ’ শুধু স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে—বাস্তবে নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সঙ্কট সমাধান করা, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সিদ্ধান্তহীনতা, জবাবদিহির অভাব ও ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। শেখ হাসিনার মনোনীত প্রেসিডেন্ট এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন—ফলে সরকারের বৈধতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্র রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা যদি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে সঙ্কট সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু তার সীমিত পদক্ষেপ প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে পারেনি। তাই এখন জরুরি একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর—যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো টিকে থাকবে, কিন্তু দুর্নীতি, লুটপাট, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা অপরাধে জড়িত নেতৃত্বকে অবশ্যই বাদ দিতে হবে। কারণ রাজনৈতিক দল হচ্ছে জনগণের সংগঠিত রূপ; দলকে অস্বীকার করা মানে গণতন্ত্রকে অস্বীকার করা।

অতএব, প্রয়োজন এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার—যেখানে থাকবে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব, নিরপেক্ষ প্রশাসন, বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী এবং তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই সরকারকে কঠোর জবাবদিহির আওতায় থাকতে হবে, যেন প্রতিটি সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ, যাচাইযোগ্য এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি হয়। শুধু এভাবেই অপরাধী নেতৃত্ব বাদ দিয়ে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে এবং নতুন শাসনব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলা যাবে—যেখানে জনগণের আস্থা ফিরবে, রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আসবে এবং ভবিষ্যতের নির্বাচন হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক।

এরপরেই জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তাদের প্রকৃত সিদ্ধান্তের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়।

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]