করোনার দিনগুলোতে মুম্বাই
মুম্বাই থেকে মুস্তাফিজ রনি
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্যতা বেড়ে গেল। মুম্বাইয়ের ফাঁকা রাস্তায় হঠাৎই যেন মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করল। তবে কেউই আড্ডা কিংবা ঘুরতে বের হয়নি। জরুরি পণ্য কিনে দ্রুত ফিরতে চাইছে নিজ নিজ ঘরে। কারণ ইতোমধ্যে পুরো ভারত ২১ দিনের জন্য লকডাউন করার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কখনো ঘুমায় না বলে প্রচলিত ভারতের এই শহরটিও তাই মঙ্গলবার রাত ১২টার আগেই নিস্তব্ধ নগরীতে পরিণত হয়। কারণ বুধবার থেকে শুরু হয়েছে লকডাউন। ২২ মার্চ জনতা কারফিউয়ের মাধ্যমে মোটামুটি আশানুরূপ ফলাফল পেয়েছে ভারত। সেজন্য মহামারি করোনাভাইরাস ঠেকাতে এবার পুরো ভারত লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কারণ করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তার ঠেকাতে আপাতত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই সবচেয়ে প্রধান সমাধান। মঙ্গলবার জনতার উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হাতজোড় করে দেশটির প্রতিটি নাগরিককে ঘরেই থাকতে অনুরোধ জানান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, পুরো বিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখে পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল ৬৭ দিন। এরপর মাত্র ১১ দিনে তা ২ লাখ এবং মাত্র ৪ দিনে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। শুধু চীন ছাড়া পুরো পৃথিবীতেই করোনার ভয়াবহতা এখনও ক্রমেই বাড়ছে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত লকডাউন করা হয় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য। এতদিন এগুলো রাজ্য সরকারের অধীনে থাকলেও গত ২২ মার্চ জনতা কারফিউ এবং এবার ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পুরো ভারত লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র সরকার।
লকডাউনের কারণে অচেনা হয়ে গেছে ভারতের বাণিজ্যিক শহর মুম্বাই। কার্যত যে শহরে ট্রাফিক জ্যাম, মানুষের ভিড়, গাড়ির হর্ন, ট্রেনে ছোটাছুটি, দূষিত বাতাস আর ব্যস্ততার বাইরে অন্য কিছু চোখে পড়াই মুশকিল সেই শহর এখন পুরোই অচেনা। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম নেই, মানুষের অবিরাম ছুটে চলা নেই, গাড়ির হর্নে কান ঝালাপালা হচ্ছে না, ট্রেনগুলো বন্ধ পড়ে আছে, উপচেপড়া ভিড় আর ব্যস্ততা যেন ছুটি নিয়েছে, নির্মল আকাশ আর দূষণমুক্ত বাতাস চারপাশে।
এখন সকালে কাক ছাড়াও অন্যান্য পাখির ডাক শোনা যায়। ‘গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া’-তে এখন মানুষের ভিড় নয়, বরং কবুতরের পদচারণা। যেই মেরিন ড্রাইভে শেষরাতেও উপচেপড়া ভিড় থাকে সেই মেরিন ড্রাইভ এখন মরুভূমি যেন। ট্রেন স্টেশনগুলো খাঁ খাঁ করছে। মানুষের ব্যতিব্যস্ততায় অস্থির হয়ে পুরো শহরটাই যেন একটু জিড়িয়ে নিচ্ছে। শুধু মুম্বাই নয়। পুরো ভারতেরই চিত্র এটা।
ভারতে শুক্রবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ৬৪০ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং এদের মধ্যে মারা গেছে ১৭ জন। আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৭ জন কেরালা রাজ্যের। এরপরই মহারাষ্ট্রতে ১৩০ জন। মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বাই, পুনে, নাগপুর, নাসিক, আরঙ্গবাদসহ প্রায় সব শহরেই বিস্তার করছে করোনাভাইরাস।
তবে লকডাউনে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন দিনমজুর শ্রেণির মানুষেরা।
প্রতিদিনের আয়ে যাদের সংসার চলে তাদের যেন হঠাৎই দিশেহারা অবস্থা। তবে এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের অনুদানে ও বেশকিছু সংগঠন তাদের নিজস্ব অনুদানে এসব মানুষদের মধ্যে খাবার ও প্রয়োজনীয় উপকরণ পৌঁছে দিচ্ছেন।
এত দীর্ঘ সময় পুরো ভারত লকডাউন থাকার কারণে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সেটি স্বীকার করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। তবে এই মুহূর্তে প্রধান চিন্তা মানুষের জীবন। ভারতের অর্থনৈতিক বছর শুরু হয় এপ্রিলে। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর তা পিছিয়ে জুলাই করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস অন্তত একটি উপকার করেছে। অসুস্থ থাকা প্রকৃতিকে সুস্থ করে তুলছে। এই মহামারি শেষে কবে নাগাদ আবার পৃথিবী স্বাভাবিক হবে জানা নেই। তবে যখনই হবে তখন হয়ত পৃথিবী এক অন্যরূপে হাজির হবে। প্রকৃতিকে রক্ষার যে শিক্ষা করোনাভাইরাস দিয়ে যাচ্ছে তা যদি আমরা মনে না রাখি তবে প্রকৃতিও হয়ত আবার নিষ্ঠুর আচরণ করবে। যত ক্ষমতাধরই হই না কেনো, প্রকৃতির প্রতিশোধের কাছে আমরা সবাই অসহায়।
মুস্তাফিজ রনি ভারতের মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী
এমআরএম/এসএ