বড্ড একা হয়ে গেছি
অডিও শুনুন
করেরহাট থেকে সাহেরখালী সীমানাহীন ছুটেচলা দিনগুলোর কথা হঠাৎ করেই মাথায় এলো। সকালের তাজা রোদের পরশ শরীরে মেখে সংবাদের খোঁজে বেরিয়ে পড়া, দিন পার করে রাতের প্রথমভাগে বাড়ি ফেরা। ব্যস্ততার ফাঁকে ছোট ছোট কাজ, কাজের সাফল্যের মুগ্ধতা। যখন এসব ধীরে ধীরে বাড়ছে তখনই তাকে বিদায় বলে নতুন করে ঠাঁই হলো এখানে।
২০১০ সালের মে মাসে মফস্বলের সাংবাদিকতা ছেড়ে ‘প্রবাসী’ হিসেবে নিজের নামও তুলেছি রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের তালিকায়। জায়গা হলো মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে। খুব বেশি যে স্বপ্ন ছিল তা কিন্তু নয়। অথচ দেখতে দেখতে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পেছনে পার করে দিয়েছি দশটি বছর।
যদিও সাধারণ জীবনযাপন আর বাবার মতো সরলতা, সততায় বাঁচার চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত। অল্পতে খুশি, অল্পতেই আনন্দ। এই অল্পতেই খুশি থাকা মানুষটিও বড্ড একা হয়ে আছি। এই একাকিত্ব অনুভব করার সুযোগ করে দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। আমার মতো অনেকেই, যারা প্রবাসে আছেন তারা এই একাকিত্ব অনুভব করছেন। এমন হবে তাও হয়ত আমাদের কেউই ভাবিনি কখনো।
অপেক্ষার সময় পার করছি বন্দিঘরে। শুধু সুস্থতা, সুরক্ষা আর সচেতনতার বাণী নয়, করে দেখানোর এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে এখানে। আইন, আইনের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা এবং প্রশাসনের মনিটরিং ব্যবস্থা এতটা উন্নত যে এই দেশটি প্রতি বহু আগেই ভালোবাসা জন্মে গেছে। অন্যান্য শহরে খুব বেশি কড়াকড়ি না হলেও দুবাইতে এখন খুব কঠোর প্রশাসন।
ঘর থেকে বের হতে হলে পূর্বেই অনলাইনে করতে হচ্ছে আবেদন। আবেদনের প্রেক্ষিতে অনুমতি এলে তবেই বাইরে যাওয়া যাচ্ছে। তাও এক পরিবার থেকে মাত্র একজন। এখন রাস্তায় হেঁটে চলা বা সাইকেল চালানোরও কোনো সুযোগ নেই। এই দুটোতেও নিতে হচ্ছে পূর্বে অনুমতি। নির্ধারিত সময় বা পছন্দমতো সময় যতটুকু চেয়ে নেওয়া যাচ্ছে বা যাবে তাও এখন সচেতন প্রবাসীরা নিচ্ছেন না এখানে।
সকলেই সম্মিলিতভাবে এই দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অবশ্য এর পেছনে সুন্দর একটি বিষয়ও আছে। এখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ দাঁড়াতে হয় না, পুলিশের টহল বা দলবদ্ধ পুলিশের অবস্থানও নিশ্চিত করা লাগছে না কোথাও। কারণ, সিস্টেম। এখানকার সিস্টেমই অটোমেটিক মানুষকে সচেতন করে তুলছে। বিষয়টা এমন- আপনি আইন মানছেন না তাহলে অটোমেটিক প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে যাচ্ছেন।
যারা গাড়িতে বের হচ্ছেন তাদের জন্য রাস্তায় বসানো ক্যামেরাগুলো তো আছেই। অনেকটা শৃঙ্খলার জীবন। সচেতনতা শেখার মতো পরিবেশ। অনেক প্রবাসী আছেন যারা বিদেশ ভ্রমণ করার পর পূর্বের তূলনায় অনেক বেশি পরিপক্ক হয়ে যান। কারণ এসব দেশের সিস্টেম। অথচ প্রবাসী মানেই দেশে এখন শত্রু শত্রু খেলা।
একটা বিষয় যোগ করি, যারা করোনার পরিস্থিতিতে দেশে গেছেন মানে প্রবাসীরা, তারা কিন্তু সকলেই অপরাধী নয়। যারা দেশে থাকেন তারা হয়ত বিষয়টি জানেন না, একজন প্রবাসী দেশে যাওয়ার জন্য অন্তত মাসখানেক আগে ছুটির আবেদন করতে হয়, ছুটি মঞ্জুর হলে অনেকে অন্তত সপ্তাহ দশদিন বা এরচেয়ে আগে বিমান টিকিট করে রাখতে হয়।
কোনো কোনো দেশ থেকে একেকটি টিকিটের মূল্য পড়ে যায় প্রায় ৫০ হাজারের কাছাকাছি। সে সময় যেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, দেখলে মনে হচ্ছিল এদের অনেকে ছুটি পেয়েছেন, বন্দি জীবন থেকে কিছুদিনের জন্য স্বজনদের সঙ্গে কাটানোর আকুতি ছিল, হয়ত অনেকে অগ্রিম টিকিট করে রেখেছিলেন। তাই তারা ছুটতে হয়েছে। ছুটে গেছেন দেশে। চাইলে আটকে দেওয়া যেত।
কিন্তু এমনটি হবে তারাও হয়ত ভাবেনি আগে। আবার কোয়ারেন্টাইন শব্দটির সঙ্গেইবা পরিচিত ছিলাম কতজন? গুজব তো ছিলই- প্রবাসীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, টাকা দাবি করছে, স্বজনদের হয়রানি করছে। মূলত সকলের জানার কথা আমাদের দেশ থেকে অন্যান্য দেশের মতো ইংরেজিতে পারদর্শী করে বা এসএসসি পাস করা লোকদের বিদেশে পাঠানো হয় না।
যারা সাধারণ শ্রমিক হিসেবে আসেন তারা স্বল্প শিক্ষা নিয়েই আসেন। যে কারণে ‘বাংলাদেশিরা অসচেতন’ এমন একটি বাক্য গায়ে লেগে থাকে সর্বদা। তবুও বিদেশের নানান আইন-কানুন তাদের কিছুটা হলেও বদলাতে সহায়ক হয়। যে যেখানে থাকে সেখানকার সিস্টেম তাকে বদলাতে সহযোগিতা করে।
সঙ্গত কারণেই বলছি, আমাদের সিস্টেমকে আরো আপডেট করতে হবে, মুখে বলা ডিজিটালকে কার্যত বাস্তবে রূপান্তর করতে হবে। আগামীতে জেনে বুঝে, অন্তত শিক্ষিত বা পারদর্শীদের বিদেশ পাঠানোর চেষ্টা করতে হবে। তাও না হলে অন্তত ইংরেজিতে বলতে পারার বা বোঝাতে পারার মতো করে তৈরি করে দিতে হবে তাদের। কারণ, জনগণের দায় অবশ্যই রাষ্ট্রকেই নিতে হয়।
সে যাই হোক। আমারও দ্রুত দেশে ফেরার কথা ছিল। আমার অপেক্ষায়ও নিশ্চয়ই আমার আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুরা অপেক্ষায় ছিলেন বা আছেন। কিন্তু ফেরা হলো না। কবে ফিরব তাও আর বলা যাচ্ছে না। ফিরতে পারব কি পারব না তাও না। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যারা দেশের বাইরে অবস্থান করছি তাদের বেশির ভাগই হয়ত দেশ নিয়েই ভাবছি বা ভাবছেন।
স্বজনদের কথাই প্রতিমুহূর্তে কল্পনা করছেন। এক সময় পরিস্থিতি ঠিক স্বাভাবিক হয়ে যাবে ভেবেই সবাইকে সচেতন করছেন। এত সবের পেছনে উদ্দেশ্য নিজের দেশ, দেশপ্রেম। স্বজনদের কাছে পাওয়া। একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে দিন যাপন। আমার মতো হয়ত অনেকেই ভাবছেন, একদিন আঁধার কেটে যাবে, এই অপেক্ষা, এই ঘরবন্দি জীবনের অবসান ঘটবে। তাইতো, এখন কেবলই সুস্থ শরীরে ঘরে ফেরার আকুতি...
কামরুল হাসান জনি, দুবাই ; সংযুক্ত আরব আমিরাত/এমআরএম/এমকেএইচ