প্রবাস জীবনে রমজানের অনুভূতি
বছর ঘুরে এলো পবিত্র মাহে রমজান। মুসলিমদের কাছে এ মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মুসলমানই এ সময় আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে।
শুক্রবার (২৪ এপ্রিল)। ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রমজান মাস শুরু হয়েছে। প্রবাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা প্রথম রোজার জন্য নিয়ত করেছে।
মধ্য ইউরোপে অবস্থিত ৭,৮২৭.৪ বর্গমাইলের ছোট একটি দেশ স্লোভেনিয়া। যার উত্তরে রয়েছে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া, পশ্চিমে ইতালি এবং দক্ষিণে আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূল অবস্থিত। ইউরোপ তথা পৃথিবীর অনেক দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও রমজান মাসের সূচনা হয়েছে।
প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অধীনে থাকা স্লোভেনিয়া আয়তনে যেমন ছোট তেমনি জনসংখ্যার বিচারেও খুব বেশি বড় নয়। প্রায় একুশ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ রাষ্ট্রে বাহিরের ইমিগ্র্যান্ট বলতে গেলে যুগোস্লাভিয়ার ফেডারেশনের অধীনে থাকা অন্যান্য দেশ যেমন- বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, ক্রোয়েশিয়া, এক সময় সার্বিয়ার অধীনে থাকা আলবেনিয়া অংশ যা কসোভো নামে পরিচিত এ সকল দেশেরই যারা বসবাস করেন স্লোভেনিয়াতে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা তাই এখানে বলতে গেলে অনেকটাই হাতেগোনা। এরপর কোনো সুসংগঠিত কমিউনিটি না থাকায় এবং একই সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানদণ্ডের বিবেচনায় ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন- ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, গ্রিস, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল এ সকল দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মতো শক্তিশালী না হওয়ায় সে অর্থে এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সে রকম কোনও যোগসূত্রও নেই। তাই রমজানের অনুভূতি এখানে বলতে গেলে অনেকটাই শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার মতো।
এরপর এ বছর পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় দেশটিতে বসবাস করা মানুষের জীবন অনেকটাই থমকে গিয়েছে। গত মাসের ১৯ তারিখ থেকেই করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করার জন্য সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে এবং দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জরুরি প্রয়োজন না হলে কেউই যেনও বাসা থেকে বাহিরে বের না হয়।
বাস, ট্রেনসহ সকল ধরনের গণপরিবহন সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। স্লোভেনিয়ার অভ্যন্তরে এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট ফ্যাক্টরি, খাবারের দোকান, সুপার শপ, পেট্রোল স্টেশন, হাসপাতাল, ফার্মেসি অর্থাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সব বন্ধ রাখা হয়েছে।
প্রত্যেক বছরই রোজার সময় আসলে প্রিয় বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে যায়। রোজার কিংবা ঈদের আনন্দ বলতে গেলে এখানে অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক, হয়তো বা যদি কখনও ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া হয় এবং সেখানে যদি ইসলাম ধর্মালম্বী অন্য কোনো ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয় তাই যা একটু আনন্দ তাকে ঘিরে এতটুকুই। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এ বছর আর সেটিও হচ্ছে না।
বাংলাদেশে যখন ছিলাম তখন আসলে বুঝিনি বিদেশে জীবন থেকে ‘অনুভূতি’ নামক একটি শব্দকে হারিয়ে ফেলব। স্লোভেনিয়াতে হয়তোবা সব রয়েছে বাংলাদেশে থাকার সময় যা চেয়েছিলাম কিন্তু নেই সেই প্রিয় মানুষগুলো। এ বছরের রমজানের প্রথম সেহরি করলাম কিন্তু আজকে পাশে নেই পরিবারের সদস্যদের কেউ, ঘুম থেকে জেগে তোলার মানুষটির জন্য আজকে মনটা কেঁদে উঠছে ভীষণভাবে।
বড় একাকী একটি জীবন, কেউই আজ পাশে নেই। মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয় না অনেক দিন। বাংলাদেশে রমজানের একেকটি দিন ছিল সত্যি অনেক আনন্দের, এখানে তার ছিটেফোঁটাও নেই। পুরাতন ঢাকার মতো এখানে নেই কোনো চকবাজার, নেই কোনো বিপণী বিতান যেখানে প্রতিদিন বিকেলে পসরা সাজিয়ে বসবে সুস্বাদু বিভিন্ন ইফতারির আইটেম। মসজিদের আজানের সুর কিংবা ঘুম ভাঙানোর গান এখন কেবল অন্তরে বাজে।
এরপর ব্যাচেলর লাইফ, একটু যত্ন করে রান্না করে খাওয়ানোর মতো কেউই নেই। কোনো রকম একটু কিছু উনুনে জ্বালিয়ে যা হয় তা দিয়েই নিজেকে চালাতে হয়। এরপর সেমিস্টারের মাঝামাঝি হওয়ায় পড়াশোনার চাপ তো আছেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে যদিও বাস্তবের ক্লাস আর অনলাইন ক্লাসের মধ্যে আসমান-জমিন ফাঁরাক কিন্ত-সঠিক সময়েই সেমিস্টার শেষ করতেই হবে।
মিডটার্ম পরীক্ষার পাশপাশি একগাঁদা হোমওয়ার্কের চাপ। থেমে নেই কোনো কিছুই। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সব কিছুতে বিষাদের মাত্রা বাড়িয়েছে অনেক। খুব শীঘ্রই দেশে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
স্বার্থকতা শুধু এক জায়গায় নিজের ভালোলাগার সে মুহূর্তগুলো শিশিরের মতো ভোরের আলোয় মিশে গিয়েছে বলে একটু করে হলেও বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা সেই সকল মানুষদের যারা খাদ্য, বাসস্থানসহ তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। এটিই হয়তোবা সিয়াম সাধনার প্রকৃত উদ্দেশ্য।
১৯৬৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘এতটুকু আশা’ নামক একটি বিখ্যাত ছবির রিলিজ হয়েছিলও। প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে সেই সময় এ চলচ্চিত্রের একটি বিখ্যাত গানের কয়েকটি লাইন ছিলো এ রকম:-
‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে খবরে পাতা ভরে
জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’
প্রতিদিনের সংবাদপত্রে ঠিক এমনভাবে হাজারো খবর ছাপা হলেও প্রবাসীদের জীবনের সেই অনুভূতিগুলো অগোচরে থেকে যায়। বুকের সমস্ত অনুভূতিকে পাথর চাপা দিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যায় তাদের অদম্য প্রচেষ্টায় আমাদের দেশকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে। এক মাস পর রমজান মাস চলে যাবে, ঈদের আনন্দে রাঙিয়ে উঠবে গোটা ধরিত্রী কিন্তু তাদের জীবন পাতার কোনও পরিবর্তন সে অর্থে আসবে না, সব কিছুই অপ্রকাশ্য থেকে যাবে। ত্যাগের মধ্য দিয়েই বোধ হয় রচিত হয় প্রবাসের জীবনের স্বার্থকতা। সব কিছু থাকলেও যে জীবন যে বড়ই রিক্ত।
এ রমজান সকলের ভালো কাটুক, ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠুক মাহে রমজানের আনন্দ। একই সাথে মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের কাছে ফরিয়াদ জানাই যেনও করোনার ভয়াবহ ছোবল থেকে খুব শীঘ্রই মুক্ত হতে পারে। অনন্ত যৌবনা বসন্তের মতো ধরিত্রী আবার ফিরে আসুক তার আগের রূপে, সব কিছু ফিরে পাক তার সেই হারিয়ে যাওয়া কর্মচাঞ্চল্য।
এমআরএম/এমকেএইচ