করোনাকালে ইউরোপে এক অন্যরকম ঈদ
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। দিনটি মুসল্লিমদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পরিচিত। একই সঙ্গে ঈদ আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবেও আয়োজিত হয়ে আসছে। বছরে দুটি ঈদ, একটি ঈদুল ফিতর অন্যটি ঈদুল-আজহা।
বছর ঘুরে আবারও পবিত্র ঈদুল আজহা আমাদের দুয়ারে সমাগত। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রত্যেক বছরের জিলহজ মাসের দশ তারিখে ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হয়। মূলত আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ) ও তার শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল (আ) এর আত্মত্যাগের স্মৃতিকে স্মরণ করে প্রত্যেক বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানেরা দিবসটি উদযাপন করে থাকেন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে ঈদ উদযাপিত হলেও ইউরোপের বেশিরভাগ দেশগুলোতে ঈদ সে অর্থে প্রাণবন্ত রূপের পসরা সাজাতে পারে না। এখানে ঈদ আসে বছরের আর আট-দশটি সাধারণ দিনের মতো। ঈদ উপলক্ষে থাকে না বিশেষ কোনো ছুটি, তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মব্যস্ততার মাঝে ঈদের দিনটি অতিবাহিত হয়।
উৎসবের পুরো আমেজ এখানে সকালের ঈদ নামাজকে ঘিরে, নামাজ শেষে যে যার মতো ছুটে যান তার নিজের কাজে। আমরা যারা শিক্ষার্থী, ছুটির দিন না হলে এদিনও আমাদেরকে দৌড়াতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিমুখে। আর যারা কর্মজীবী, অন্যান্য সাধারণ দিনের মতো ঈদের দিনও তাদের জন্য এক কর্মব্যস্ত দিন। ঈদ আনন্দ অনেকক্ষেত্রে তাই এখানে নিছক এক কল্পনা মাত্র।
বাংলাদেশে ঈদুল আজহাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর হাট বসতে দেখা যায়। ঈদে সবার মাঝে এক বিশেষ ধরনের উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে পরিবারের বাচ্চাদের মাঝে অন্যরকম এক উৎসাহ দেখা যায়। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কোরবানির পশুর হাট ভ্রমণ করা এবং কোরবানির জন্য পছন্দের পশুটিকে বাছাই করা নিয়ে তাদের মাঝে একধরনের উত্তেজনার লক্ষ্য করা যায়।
ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে বাংলাদেশের মতো এভাবে পশুর হাটের রীতি নেই। পাশাপাশি আমাদের দেশের মতো ইউরোপের বেশিরভাগ দেশগুলোতে জনসম্মুখে পশু জবাই করা নিষিদ্ধ। যারা সামর্থ্যবান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নিকটস্থ কোনও মসজিদের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অথবা কোনও মাংসের দোকানের সাথে যোগাযোগ করে কোরবানির ব্যবস্থা করে।
নিজের পছন্দ অনুযায়ী পশু নির্বাচনের সুযোগ এখানে অত্যন্ত সীমিত। তবে মুষ্টিমেয় কিছু দেশে যেমন- তুরস্ক কিংবা আলবেনিয়াতে দেখেছি সেখানকার স্থানীয় অনেক অধিবাসী খামারিদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের পছন্দসই পশু বাছাই করতে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়েপড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এ বছর গোটা বিশ্বে ঈদ আনন্দ অনেকটা ম্লান। ইউরোপও এর ব্যতিক্রম নয় তবে সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন সেকেন্ড ওয়েভে আবারও করোনা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে চলেছে ইউরোপ।
বিশেষজ্ঞদের দাবি করছেন লকডাউন শিথিল পরবর্তী ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাঝে আন্তঃসীমান্ত সংযোগ পুনরায় চালু করার পাশাপাশি মানুষের অবাধ যাতায়াত বৃদ্ধি এবং আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা থেকে সরে আসার কারণে মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।
গ্রিস, স্লোভেনিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া, অস্ট্রিয়া ইউরোপের এ সকল প্রথম ধাপে করোনা মোকাবিলায় অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিলেও দ্বিতীয় ধাপে নতুন করে করোনার সংক্রমণ দেশটির সাধারণ মানুষের মাঝে কপালে ভাঁজের পড়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাঁটিয়ে গোটা ইউরোপ যেখানে পুনরায় অর্থনৈতিক পুনর্জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছিল, ঠিক এমন সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আবারও যেনো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশেষত এখন ইউরোপে গ্রীষ্মকাল এবং বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এ সময়টিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পর্যটন শিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসারিত থাকে। ইউরোপের অর্থনীতির একটা বড় অংশ এ পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু উদ্ভূত করোনা পরিস্থিতিতে আশানুরূপভাবে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় আর্থিকভাবে এক বিশাল বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে গোটা ইউরোপ।
ইউরোপে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সিংহভাগই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত। রেস্টুরেন্টগুলোতে বিভিন্ন ধরনের কাজের মাধ্যমে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। লকডাউন পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন সরকারি নির্দেশ মোতাবেক এ সকল রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখতে হয়েছিল, অন্যদিকে এখনও পুরোপুরিভাবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলে না যাওয়ায় আশানুরূপভাবে খদ্দের সমাগম হচ্ছে না এ সকল রেস্টুরেন্টগুলোতে।
ফলে এ সকল রেস্টুরেন্টের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পাশাপাশি যোগ হয়েছে বেকারত্ব। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে যার প্রেক্ষিতে অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। চরম হতাশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন। এমন পরিস্থিতিতে তাই ঈদ আনন্দ একটি দুঃস্বপ্নের নাম, এছাড়াও এবারের ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে মুসল্লিরা জামায়াতবদ্ধভাবে ঈদের নামাজে শরিক হতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়।
সবধরনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবকে বুকে চাপা দিয়ে এগিয়ে চলে প্রত্যেক প্রবাসীর জীবন। একটাই লক্ষ্য শুধু এ জীবনের আর সেটা পরিবারের প্রিয় মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোঁটানো। বাংলাদেশে থাকতে বাবার সাথে প্রত্যেক বছর হাটে যাওয়ার সৌভাগ্য হত পছন্দের পশুটি কেনার জন্য। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ঈদ জামায়াতে শরিক হতাম। নামাজ শেষে পশু কোরবানি করতাম এবং নিজ হাতে কোরবানি গোশত তিন ভাগ করে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনসহ সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মাঝে বণ্টন করতাম।
এ দিনগুলো এখন আমার কাছে কল্পনা বৈ আর কিছুই নয়। মস্তিষ্কের স্মৃতিপটে সে দিনগুলো এখন কেবল নিছক স্মৃতি। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস যেন এসব হাহাকারকে আরও এক ধাপ গভীরে নিয়ে গেছে। জানি না কবে এ পৃথিবী কবে এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবে এবং সবকিছু আগের ছন্দে ফিরে আসবে।
সবাইকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠুক দিনটি। ঈদ সকলের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল প্রশান্তি এবং সমৃদ্ধি। সমাজের মানুষের মাঝে বিদ্যমান সকল বৈষম্য দূরীভূত হয়ে যাক।
এমআরএম/এমএস