করোনার ধাক্কা : সামাল দিতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ
করোনাভাইরাসের হানায় থমকে গেছে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পুরো বিশ্ব পতিত হয়েছে আর্থিক মন্দার কিনারে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতেও। এ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে কর্মসংস্থান, রফতানি, প্রবাসী আয়সহ অভ্যন্তরীণ বাজারে সৃষ্টি হবে বড় সঙ্কট। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা নীতি-নির্ধারকদের সামনের দিনগুলোতে ঘুরে দাঁড়াতে করণীয় ঠিক করতে বলছেন। তারা বলছেন, আর্থিক এ ক্ষতি মোকাবিলায় সুপরিকল্পিত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।
গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে হেলিয়ে দেয়া করোনাভাইরাসের কারণে দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকায় প্রভাব পড়েছে বলে এরইমধ্যে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা না করলে এবং সে অনুসারে কাজ না করলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের অবস্থা বেশ খারাপ। সেজন্য বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার এ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে অনেক বেশি পরিমাণ লোন করেছে। সেটা যদি আরও বাড়ে তাহলে এমনিতেই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে, এটা আরও কমবে। তার ফলে বিনিয়োগ হবে না, নানা ধরনের সমস্যা হবে। কাজেই এ সংকট বিবেচনায় চলতি ও আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কমানো যেতে পারে। অগ্রাধিকারযুক্ত প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব বেশি দিয়ে কম অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো বাদ দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
মির্জ্জা আজিজুল আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, মানুষকে রক্ষা করতে হলে চলতি ও আগামী বাজেটকে সাধারণভাবে চিন্তা করলে চলবে না। বর্তমানে একটা জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এটা অনিশ্চিত যে কতোদিন এভাবে চলবে সেটা কারও জানা নেই।
তিনি বলেন, দেশের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিটি বাজেটেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় কিছু বরাদ্দ থাকে। ইতোমধ্যে করোনায় দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, সাধারণ মানুষ যারা, তাদের কাজে ব্যাপক ব্যত্যয় হয়েছে। তাই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াও একটি বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে। যাতে করে খাদ্যের অভাব দেখে দিলে সে তহবিল থেকে এসব মানুষকে খাওয়ানার ব্যবস্থা করা যায়।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, প্রতিবছরই কিছু অলংকারধর্মী কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। যেমন ট্রেনিং প্রোগ্রাম, যেগুলো এ বছর না হলেও চলবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান যেগুলোর প্রয়োজন নেই, সেগুলো বাদ দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে খাদ্য নিরাপত্তা ঠিক রাখতে হবে। একইসঙ্গে বেশি বেশি অর্থ স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিরাপত্তায় ব্যয় করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, করোনা চলে গেলেই শেষ হয়ে গেলো তা নয়। করোনা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে স্বাস্থ্যখাতে আমাদের আরও অগ্রগতি দরকার। চলমান বাজেটে রাজস্ব আদায় খুব খারাপ ছিল, এখন আরও খারাপ হবে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ইতোমধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে অনেক টাকা ধার করেছে। এ অবস্থায় বিশ্ব্যব্যাংক এবং আইএমএফ থেকে তহবিল সংগ্রহে ভালো প্রস্তুতি থাকা দরকার। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এসব দাতা সংস্থার সাথে যেন সরকার নেগোসিয়েট করতে পারে।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এ মহুর্তে সবচেয়ে অগ্রাধিকার হচ্ছে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এজন্য চলতি ও আগামী বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যেসব চ্যানেল আছে সেসব জায়গায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এসব খাদ্য বিতরণে যেন কোনো ধরনের দুর্নীতি না হয় সে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়, তাই প্রয়োজনে এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ীদের দিকে নজর দেয়া দরকার। বড় ব্যবসায়ীরা নিজস্ব সঞ্চয় থেকে হয়তো টিকে থাকতে পারবে। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেটা পারবে না। সেক্ষেত্রে শিল্প ক্ষেত্রে প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণ ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের জন্যেই করতে হবে। সর্বোপরি দেশের মনুষের হাতে যদি টাকা থাকে এবং সে টাকা যদি মানুষ খরচ করে তাহলেই অর্থনীতির চাকা ঘুরবে। কাজেই সে জায়গায় সরকারের যেসব জরুরি প্রকল্প রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন অব্যহত রাখতে হবে। কিন্তু যেসব প্রকল্প এমন আছে যে আগামী ছয় মাস বা এ বছরে না করলেও চলবে, সেগুলো বাদ দিতে হবে।
চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস এখন বৈশ্বিক মহামারি। এতে এখন পর্যন্ত সোয়া ৬ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় ২৯ হাজার। বাংলাদেশে করোনায় এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮ জন, মারা গেছেন ৫ জন।
করোনার কারণে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গণপরিবহনও। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঠেকাতে লোকজনকে ঘরে রাখার জন্য রাস্তায় নামানো হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীও। করোনার এ প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ভুগছে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ। যদিও কেউ যেন না খেয়ে থাকে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এমইউএইচ/এইচএ/জেআইএম