করোনায় বাজারব্যবস্থা ভেঙে গেছে, পুনর্নির্মাণ সরকারের দায়
ড. আতিউর রহমান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট বিভাগে। করোনাকালীন পরিস্থিতি, অর্থনীতি, কৃষি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংকট এবং এসব সংকট উত্তরণে করণীয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র।
‘আগামী বাজেট হতে হবে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট’— এমনটি উল্লেখ করে আগামী তিন বছর টানা স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়ানোর পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বাজার চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষক বাঁচানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : করোনা পরিস্থিতি অনেক বিষয়-ই সামনে আনছে। এর মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের তাগিদ। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আতিউর রহমান : করোনা পরিস্থিতি দুটি সংকট আমাদের সামনে এনেছে। এর মধ্যে প্রথম সংকট হচ্ছে স্বাস্থ্যগত। আমরা বেঁচে থাকব কি-না, এটি নিয়েই আপাতত ভাবতে হচ্ছে। যে কারণে মানব জাতির বেঁচে থাকার জন্য প্রথমত ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানো গুরুত্ব পাচ্ছে।
জাগো নিউজ : এই প্রশ্নে আসলে করণীয় কী?
আতিউর রহমান : আপাতত পরীক্ষা বেশি পরিমাণে করা। আক্রান্ত হলেই রোগীকে আলাদা করে ফেলা বা আইসোলেটেড করে সেবা প্রধান করা। যারা ভালো আছেন, তাদের উচিত সচেতন থেকে জীবনযাপন করা।
একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবীদের যত দূর সম্ভব করোনামুক্ত রাখা। কারণ, তাদের আক্রান্তের মাত্রা বাড়লে সবার মধ্যেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং যারা মানুষের সেবায় আছেন, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
জাগো নিউজ : বলছিলেন, স্বাস্থ্য খাত প্রসঙ্গে। সামনে জাতীয় বাজেট। বাজেট আলোচনায় এ খাত প্রসঙ্গে কী বলবেন?
আতিউর রহমান : আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাত একেবারে কেন্দ্রে এনে আলোচনা করতে হবে। মূলত, আগামী বাজেট হতে হবে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট। হয়ত আগামী তিন বছর ধরে টানা স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়াতে হবে। এ খাতে এখন যে বরাদ্দ, তা জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। এটি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে। আমি মনে করি, একপর্যায়ে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ জিডিপির ৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা অনেক ভালো করেছি। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে আমাদের আরও অনেক উন্নয়ন করতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। মেডিকেল কলেজগুলোকে আরও আধুনিক করতে হবে। আরও অধিক সংখ্যক ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
এসবের জন্য অবশ্যই অর্থের প্রয়োজন। এ কারণেই বলছি, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য প্রশাসনকে আধুনিক করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে নেতৃত্ব দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। যে কারণে আশা করছি, তিনিও এবার স্বাস্থ্য খাতের জন্য বিশেষ বার্তা দেবেন।
জাগো নিউজ : দ্বিতীয় সংকটের কথা কী বলবেন?
আতিউর রহমান : করোনার কারণে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের বহু মানুষের আয় কমেছে। আয় কমে যাওয়ার কারণে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে হয়তো খাদ্য আছে। কিন্তু নগদ টাকা না থাকায় অনেকেই কিনতে পারছেন না। আমরা এসব মানুষকে সহায়তার কথা বলছি। সরকারও সাড়া দিচ্ছে। ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ ২৫০০ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরও ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে চালসহ অন্যান্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় এক কোটি পরিবার সরকারি সহায়তার অধীনে চলে এসেছে। তবে ডিজিটাল সিস্টেমে এনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
জাগো নিউজ : করোনা কৃষির জন্যও চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে করণীয় কী?
আতিউর রহমান : আমাদের আশীর্বাদ হচ্ছে, এ বছর কৃষির উৎপাদন ভালো। চালের উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে আবির্ভূত হয়েছে এবার। শাক-সবজি উৎপাদনেও আমরা অনেক ভালো করছি। ফল-ফলাদিতেও এখন ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ। সুতরাং উৎপাদন নিয়ে আমাদের বড় সংকট থাকছে না।
ইতোমধ্যে আমাদের আধুনিক কৃষক অনেক তৈরি হচ্ছে। আবার চুক্তিভিত্তিক কৃষিকাজেও অনেকে এগিয়ে আসছে।
জাগো নিউজ : উৎপাদন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণ নিয়ে তো হতাশা বাড়ছে…
আতিউর রহমান : উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে এগিয়ে যেতে পারিনি। আমের বাজার নিয়েই আলোচনা করা যেতে পারে। সারাদেশে আম উৎপাদন হলেও পাঁচটি বিশেষ অঞ্চলকে প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। পরে হয়তো আরও বাড়ানো যাবে। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে আম আসবে। সেখান থেকে মান যাচাই করে আলাদা করতে হবে। একটি অংশ রফতানির জন্য, আরেকটি অংশ আমজাত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তো দাঁড়িয়ে গেছে এই আমের ওপর নির্ভর করেই।
একইভাবে গ্রামের আম যেন শহরের মানুষের কাছে পৌঁছায়, সেজন্য রেল বা কাভার্ডভ্যানের মাধ্যমে সরবরাহ করা যেতে পারে। আজ ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানোর সহজ উপায় হচ্ছে ই-কমার্স। একই উপায়ে প্রতিটি পণ্যই সরবরাহ করা সম্ভব।
জাগো নিউজ : ব্যক্তি উদ্যোগে ই-কমার্সেরও পরিধি বাড়ছে। সরকারের কিন্তু সাড়া নেই…
আতিউর রহমান : আমরা বহুবার সরকারকে এ ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছি। ই-কমার্সভিত্তিক একটি পোর্টাল খোলার কথা বলেছে সরকার। উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারের জনবল বাড়াতে হবে।
এই জনবল ব্যবহার করেই চাহিদা বাড়াতে হবে। যেমন- জেলখানাতে সরকার আম, লিচু সরবরাহ করতে পারে। হাসপাতাল, আর্মি, পুলিশ ব্যারাকে ফল দিতে পারে। করোনাকালীন সময়ে কৃষিকে বাঁচাতে হলে চাহিদা বাড়াতে হবে। সরকার ক্রয় করে চাহিদা বাড়ালে গ্রামের পণ্যগুলো বিক্রি হবে।
সরকার চাইলে রাজশাহী বা চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, যেখানে পাইকারদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হতে পারে। পণ্য কেনার সময় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সার্টিফিকেট দিতে হবে। পরিবহনে যেন কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হয়। প্রয়োজনে টোল কমানো বা খালি ট্রাক ফেরত গেলে কিছু ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। এগুলোই সরকারের দায়।
করোনায় বাজারব্যবস্থা ভেঙে গেছে, পুনর্নিমাণ সরকারের দায়। উৎপাদক-পাইকার এবং ক্রেতার মধ্যে একটি সংযোগ সেতু তৈরি করে দেবে সরকার। ডিজিটাল ব্যবস্থায় এই সংযোগ করতে পারলে আরও ভালো। বিএডিসি প্রতি জেলা-উপজেলায় কৃষি মার্কেট করতে পারে। কৃষকের মূল্য না দিলে সব ভেঙে পড়বে।
৫০ লাখ পরিবারকে যদি সঠিকভাবে নগদ টাকা মোবাইলে প্রদান করা যায়, তাহলে কৃষি ব্যবস্থাতেও সঠিকভাবে প্রণোদনা দেয়া সম্ভব।
জাগো নিউজ : কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইলে নগদ টাকা প্রদানেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে…
আতিউর রহমান : টাকা এখনও বণ্টন হয়নি। অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে মানে, সিস্টেমে সমস্যা আছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় করতে পারলে অনিয়ম ঠেকানো সম্ভব।
জাগো নিউজ : অনিয়মের অভিযোগ সর্বত্রই। করোনাকালেও ত্রাণের চাল চুরি হলো…
আতিউর রহমান : এ কারণেই আমি বারবার ডিজিটাল সিস্টেমের ওপর জোর দিচ্ছি। জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রশাসন চিহ্নিত করতে পারে, কে আসলে প্রকৃত কৃষক। তাহলে ধান বিক্রি নিয়ে আর ঝামেলা থাকছে না। জাতীয় পরিচয়পত্র তো দুর্নীতিরোধে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সবকিছু রাজনীতিকীকরণ করলে চলবে না। আমরা বিশেষ একটি মুহূর্ত অতিক্রম করছি। প্রশাসনকে অন্তত রাজনীতির বাইরে রেখে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে ওপরের স্তরের প্রশাসনকে দিয়ে মনিটরিং করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবার বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছে। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে অবশ্যই দুর্নীতি কমানো সম্ভব।
এএসএস/এমএআর/এমএস