করোনায় বিক্রি হচ্ছে আসবাবপত্রসহ সাজানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
অডিও শুনুন
করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীর অলিগলির অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। অনেক স্কুলের সামনে ‘টু-লেট’ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে আবার আসবাবপত্রসহ স্কুল-কলেজের মালামাল বিক্রির নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন। গত পাঁচ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাড়িভাড়া, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন আটকে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তি ও টিউশন ফি আদায় করতে না পেরে অনেক সাজানো প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর মিরপুর শাহআলী থানার পাশে মিরপুর-১, নিউজ সি ব্লক ৭ নম্বর বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলা মিডিয়াম গোল্ড মাইন্ড স্কুল। প্লে শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৩০ জন শিক্ষক ও শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানে। পাঁচ বছর আগে প্রতিষ্ঠা হলেও করোনা পরিস্থিতির জন্য গত পাঁচ মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির আহমেদ স্কুল হিসেবে গড়ে তোলা বাসাটি ছেড়ে দেয়ায় গেটে ‘টু-লেট’ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
গোল্ড মাইন্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। অনেক স্বপ্ন ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে। তবে সকল স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গত পাঁচ মাস ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে স্কুলটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাড়ির মালিককেও বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছি। তিনি নতুন ভাড়াটিয়া পেতে ‘টু-লেট’ ঝুলিয়ে দিয়েছেন।”
মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধের ঢাকা উদ্যান এলাকার নবীনগর হাউজিং ৪ নম্বর সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুল’। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক তকবীর আহমেদ শিশুদের জন্য এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। করোনাকালে বিদ্যালয়ের টিউশন ফিসহ সবরকম আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়ে তিনি এখন বিদ্যালয়টি বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত এক মাস ধরে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন অলিগলিতে তার স্কুলটি বিক্রির বিজ্ঞাপন সংবলিত পোস্টার নিজ হাতে সেঁটে চলেছেন। ভালো ক্রেতা পেলে আসবাবপত্রসহ স্কুলটি বিক্রি করে দেবেন। তকবীর আহমেদ বলেন, ‘স্কুল বিক্রি না করলে চলবে কী করে? চার মাস ধরে স্কুলের কোনো আয় নেই। প্রতি মাসে ভবনের ভাড়া দিতে হয় ৪৬ হাজার টাকা। ৫০ হাজার টাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন। আছে আরও অন্যান্য খরচ।’
তিনি বলেন, ‘মার্চ মাস থেকে বাচ্চারা (ছাত্রছাত্রী) কোনো টাকা-পয়সা দিচ্ছে না। বিজ্ঞাপন দিয়েও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ফলাফল শূন্য। ২০০৪ সাল থেকে তিলে তিলে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছি। প্লে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আড়াইশ শিক্ষার্থী রয়েছে। ১২ জন শিক্ষক ও দুজন কর্মচারী রয়েছেন। নিম্নআয়ের মানুষ, বাসাবাড়িতে যাদের বাবা-মা কাজ করে, গার্মেন্ট শ্রমিক, সিএনজি, অটো ড্রাইভার, ট্যানারি শ্রমিকের সন্তানরা এই বিদ্যালয়ে পড়ে। তারা কোনোভাবেই করোনাকালে টিউশন ফি দিতে রাজি নয়।’
মিরপুর-২-এর ১১ নম্বর রোডের ৪০ নম্বর বাসায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘বেলফাস্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।’ গত বছর প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করে ইংলিশ মিডিয়ামের এ স্কুলটি গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী ও ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তবে করোনা পরিস্থিতিতে স্কুলটির বাড়িভাড়া লাখ টাকাই উঠছে না। তার ওপরে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন তো রয়েছেই। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া হবে নাকি চালিয়ে যাবেন-এ নিয়ে দোটানায় রয়েছেন স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতারা।
স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মো. রহমাতুজ জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ইংলিশ মিডিয়ামের এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়া স্কুলটির পেছনে প্রতি মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়। বর্তমানে ব্যয়ের ২০ শতাংশ আয় হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে স্কুলটি বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনার কারণে স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার পথে রাজধানীর শান্তিবাগে অবস্থিত ঢাকা ক্যাডেট স্কুল, ফার্মগেটে ঢাকা মেট্রোপলিটন হাইস্কুল ও কলেজ, রাহবার পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আল হিকমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মিরপুর রূপনগরে হলি চাইল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রামপুরার বাগিচারটেকে অবস্থিত ইকরা আইডিয়াল, মিরপুর কাজীপাড়ার শাইনিং স্টার স্কুল। এছাড়া শহরের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বন্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে দেশের প্রায় ৭০ ভাগ কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে বেকার হয়ে পড়বেন প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। সরকারের আর্থিক সহায়তা না পেলে এই ১০ লাখ পরিবার চরম দুর্ভোগে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘স্কুল মালিকদের একদিকে বাড়িওয়ালার বাড়িভাড়ার চাপ, অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের চাপ, তাদের পরিবারের অর্থকষ্ট, পরপর দুটি ঈদ-সবমিলিয়ে দিশেহারা অবস্থা।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন এবং সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক কোটিরও বেশি শিশু শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া ১০ লক্ষাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার আহার জোগানো এখন কষ্টকর। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ১৬ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অর্থনৈতিকভাবে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন সবাই।’
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম রনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শহরের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক বেকার শিক্ষিতদের চাকরির সুযোগ মিললেও বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে বন্ধ থাকায় অনেকে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিচ্ছেন। অনেক শিক্ষক গত পাঁচ মাস ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতন জীবনযাপন করছেন। বেতন না পেয়ে অনেকে আবার শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।’
বর্তমানে অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলছেন বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি শিক্ষক সমিতির এই সভাপতি। তিনি বলেন, শহরের বিভিন্ন বিল্ডিং ও ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তারা স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে তারা অনেক অর্থ আয় করলেও কয়েক মাস স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না। অসাধুভাবে যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এমএইচএম/এসআর/এমকেএইচ